মদিনায় হিজরত: উমর ইবনুল খাত্তাব, আইয়াস ইবনে আবি রাবিয়া ও হিশাম ইবনুল আস | মদিনায় প্রাথমিক পর্যায়ে হিজরত, উমর ইবনুল খাত্তাব (রা) যখন মদিনায় হিজরত করার সিদ্ধান্ত নেন, তখন তিনি যাত্রাপথে দুজন সাহাবিকে সঙ্গে নেওয়ার পরিকল্পনা করেন। তাঁরা হলেন আইয়াস ইবনে আবি রাবিয়া ও হিশাম ইবনুল আস (আমর ইবনুল আসের ভাই)। তাঁরা মক্কার বাইরের একটি নির্দিষ্ট উপত্যকায় সাক্ষাৎ করার পরিকল্পনা করলেন। তাঁদের সিদ্ধান্ত ছিল, ওইদিন সকালে যে বা যারা সেখানে পৌঁছুবেন তিনি বা তাঁরা মদিনার উদ্দেশে রওয়ানা হবেন; আর কেউ যথাসময়ে পৌঁছুতে না পারলে ধরে নেওয়া হবে যে সে কোনোভাবে বাধাপ্রাপ্ত হয়েছে।
মদিনায় হিজরত: উমর ইবনুল খাত্তাব, আইয়াস ইবনে আবি রাবিয়া ও হিশাম ইবনুল আস | মদিনায় প্রাথমিক পর্যায়ে হিজরত | মহানবী হযরত মুহাম্মদ ( সাঃ ) জীবন
হিশাম নির্ধারিত সময়ে সেখানে হাজির হননি। তাই আইয়াস ও উমর তাঁকে ছাড়াই মদিনার উদ্দেশে যাত্রা করেন এবং একসময় সেখানে পৌঁছেন। আইয়াস ছিলেন আবু জেহেলের বৈমাত্রেয় ভাই। তাঁর চলে যাওয়ার খবর পেয়ে আবু জেহেলও তার আপন ভাইকে সঙ্গে নিয়ে মক্কা থেকে পুরো পথ পাড়ি দিয়ে মদিনায় গিয়ে বলল, “হে আইয়াস! তুমি কি বুঝতে পারছ তুমি কী করেছ? তুমি চলে আসার পর আমাদের মায়ের কী অবস্থা হয়েছে তা কি তুমি জান? তিনি কিছুই খেতে কিংবা পান করতে পারছেন না।
তিনি আল্লাহর কাছে প্রতিজ্ঞা করেছেন, তোমাকে না দেখা পর্যন্ত তিনি বাইরে রোদে বসে থাকবেন। তিনি মাথার চুল উকুনে ভরিয়ে ফেলেছেন। তিনি এখন মৃত্যুর দ্বারপ্রান্তে, ইত্যাদি ইত্যাদি।” এটা ছিল ইমোশনাল ব্ল্যাকমেলের চেষ্টা। যা-ই হোক, তাদের কথা বিশ্বাস করে আইয়াস তাদের সঙ্গে মক্কায় ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। তা জানতে পেরে উমর (রা) বললেন, “আইয়াস, ওরা তোমার সাথে চালাকি করছে। তোমার মা যদি সত্যিই ক্ষুধার্ত হয়ে থাকেন তাহলে তিনি খাবার খেতে পারেন। যদি তাঁর মাথায় উকুন থেকে থাকে, তবে তিনি চুল কামিয়ে ফেলতে পারেন। সে জন্য তোমাকে সেখানে যেতে হবে না।”
কিন্তু আইয়াস কিছুটা জোর করেই বললেন, “আমি ছেলে হিসেবে প্রয়োজনীয় দায়িত্ব পালন করতে চাই। আমাকে আমার মায়ের কাছে ফিরে যেতে দিন। তাঁকে সুস্থ করে তোলার পর আমি আবার মদিনায় ফিরে আসব। তা ছাড়া আমার কিছু সেখানে আছে, টাকাগুলোও নিয়ে আসতে হবে।” উমর (রা) বললেন, “যদি টাকা আনাই তোমার উদ্দেশ্য হয়, তোমার যত টাকা লাগে আমি তোমাকে দেব। তবু তুমি সেখানে যেও না। আর যদি তোমার মায়ের ব্যাপার হয়, তবে তিনি নিজের ব্যবস্থা নিজেই করতে পারবেন।”

ওদিকে আবু জেহেল জেদ করেই চলেছে। একপর্যায়ে আইয়াসের মন গলে গেল এবং তিনি মক্কায় যাওয়ার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললেন। উমর (রা) তখনো নিশ্চিত ছিলেন যে, আবু জেহেল ও তার ভাই মিথ্যা কথা বলছে, ছলনার আশ্রয় নিচ্ছে। তাই তিনি আইয়াসকে একপাশে টেনে নিয়ে বললেন, “তুমি যখন যাচ্ছেই। তাহলে আমার উটটা নিয়ে যাও। এটা ওদের উটের চেয়ে দ্রুতগামী ও শক্তিশালী। যদি তুমি ওদের মধ্যে বিশ্বাসঘাতকতার কোনো লক্ষণ দেখতে পাও, তাহলে সঙ্গে সঙ্গে এই উটে চড়ে সোজা মদিনায় ফিরে আসবে।
আইয়াস তাদের সঙ্গে মক্কায় যাওয়ায় জন্য রওনা হলেন। সঙ্গে নিলেন। উমরের (রা) দেওয়া উটটি। কিছুদূর চলার পর গল্পগুজব ও হাসিঠাট্টা শুরু হলো। আইয়াস যখন তাদের সঙ্গে কথা বলে কিছুটা স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতে শুরু করেছেন, তখন আবু জেহেল বলল, “দেখো, আমার উটটা বেশ ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। তোমারটা তো দেখছি বেশ শক্তিশালী। আমাদের তোমার উটের ওপর একটু চড়তে দাও। এই ফাঁকে আমাদেরটা একটু বিশ্রাম নিক। আইয়াস সরল মনে তাঁর উটে আবু জেহেলকে চড়তে দিলেন। সঙ্গে সঙ্গে তারা তাঁর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে তাঁকে বেঁধে ফেলল এবং বন্দি অবস্থায় মক্কায় ফিরিয়ে নিয়ে গেল। তারা তাঁকে মক্কা শহরের বিভিন্ন প্রান্তে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে সবাইকে দম্ভভরে বলতে লাগল, “আমরা বোকাদের সঙ্গে এরকম আচরণই করে থাকি।” নবিজি (সা) তখনও মক্কায় অবস্থান করছিলেন; তিনি এই দৃশ্য প্রত্যক্ষ করেন।
আইয়াস মক্কায় গিয়ে দেখতে পেলেন, কুরাইশরা হিশামকেও (যার তাঁদের সঙ্গে মদিনায় হিজরত করার কথা ছিল) বন্দি করে রেখেছে। কুরাইশরা আইয়াস ও হিশামের জন্য মক্কায় একটি বিশেষ কারাগার বানিয়ে দুজনকে সেখানে এক অন্ধকার প্রকোষ্ঠে রেখে দিল। নবিজি (সা) হিজরত করার পর তাঁদের ও মক্কার নিপীড়িত মুসলিমদের জন্য দোয়া করেন: “হে আল্লাহ! আইয়াসকে বাঁচান, হিশামকে বাঁচান, দুর্বলদেরকে রক্ষা করুন এবং কুরাইশদের শাস্তি দিন।”
তিনি মদিনার মুসলিমদের জিজ্ঞেস করলেন, “আইয়াসকে বাঁচাতে কে এগিয়ে আসবে? হিশামকে বাঁচাতে কে এগিয়ে আসবে?” তাঁদের বাঁচাতে যাওয়ার অর্থ সিংহের খাঁচায় পা দেওয়ার শামিল। স্বাভাবিকভাবেই কেউ এগিয়ে আসেনি। অবশেষে খালিদ ইবনে ওয়ালিদের বড় ভাই আল-ওয়ালিদ ইবনুল ওয়ালিস এগিয়ে এসে বললেন, “হে আল্লাহর রসুল! আমি করব।” কথামতো তিনি মক্কার উদ্দেশে যাত্রা করলেন এবং মধ্যরাতে শহরে প্রবেশ করলেন। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার অনুগ্রহে তিনি সে অন্ধকার প্রকোষ্ঠটি খুঁজে পেলেন। তারপর তাতে প্রবেশ করে আইয়াস ও হিশামের বাঁধন কেটে উভয়কে উদ্ধার করে মদিনায় ফিরিয়ে আনলেন।
আরও পড়ূনঃ
- কিনদা উপজাতি | ইয়াসরিবের জন্য বীজ রোপণ | মহানবী হযরত মুহাম্মদ ( সাঃ ) জীবন
- বনু শায়বান ইবনে সালাবা | ইয়াসরিবের জন্য বীজ রোপণ | মহানবী হযরত মুহাম্মদ ( সাঃ ) জীবন
- ইয়াসরিনের একটি ছোট উপজাতি: খাজরাজ | ইয়াসরিবের জন্য বীজ রোপণ | মহানবী হযরত মুহাম্মদ ( সাঃ ) জীবন
- খাজরাজরা কেন ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন? | ইয়াসরিবের জন্য বীজ রোপণ | মহানবী হযরত মুহাম্মদ ( সাঃ ) জীবন
- খাজরাজের কাছে দাওয়াত থেকে শিক্ষণীয় | ইয়াসরিবের জন্য বীজ রোপণ | মহানবী হযরত মুহাম্মদ ( সাঃ ) জীবন