আবু তালিবের মৃত্যু | খাদিজা (রা) ও আবু তালিবের মৃত্যু | মহানবী হযরত মুহাম্মদ ( সাঃ ) জীবন

আবু তালিবের মৃত্যু | খাদিজা (রা) ও আবু তালিবের মৃত্যু, মক্কার বাইরের উপত্যকায় প্রায় আড়াই বছর কাটানোর পর বয়কট শেষ হলে নবিজি (সা) ও অন্যরা মক্কায় ফিরে আসেন। সময়টা ছিল দাওয়াতের ১০ম বছর। ফেরার সঙ্গে সঙ্গে নবিজির (সা) জীবনে তিনটি বড় বিপর্যয়কর ঘটনা ঘটে: চাচা আবু তালিবের মৃত্যু, স্ত্রী খাদিজার (রা) মৃত্যু এবং তায়েফের ঘটনা। এসব কারণে পুরো বছরটিকে ‘আম আল-হুজান’ (দুঃখের বছর) বলে অভিহিত করা হয়।

আবু তালিবের মৃত্যু | খাদিজা (রা) ও আবু তালিবের মৃত্যু | মহানবী হযরত মুহাম্মদ ( সাঃ ) জীবন

 

আবু তালিবের মৃত্যু | খাদিজা (রা) ও আবু তালিবের মৃত্যু | মহানবী হযরত মুহাম্মদ ( সাঃ ) জীবন

 

আবু তালিবের মৃত্যু

বনু হাশিম মক্কায় ফিরে আসার মাত্র পাঁচ-ছয় সপ্তাহ পর আবু তালিব অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং শেষ পর্যন্ত দাওয়াতের দশম বছরের শাওয়াল মাসে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। সহিহ বুখারিতে বর্ণিত আছে, আবু তালিব যখন মৃত্যুশয্যায়, তখন নবিজি (সা) খবর পেয়ে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে যান। তিনি দেখলেন, আবু জেহেল ও আবদুল্লাহ ইবনে আবি উমাইয়া ইবনে মুগিরা প্রমুখ ব্যক্তি আবু তালিবের শয্যাপাশে বসে আছে।

নবিজি (সা) আবু তালিবকে উদ্দেশ করে বললেন, “হে আমার চাচা! আপনি শুধু বলুন, ‘আল্লাহ ছাড়া আর কোনো উপাস্য নেই’, যাতে আমি আল্লাহর দরবারে আপনার জন্য সুপারিশ করতে (অথবা সাক্ষী হতে) পারি।” আবু তালিব যখনই কালেমাটি বলার উপক্রম করলেন, তখনই সেখানে দাঁড়ানো আবু জেহেল ও আবদুল্লাহ ইবনে আবি উমাইয়া বলে উঠল, “হে আবু তালিব।

আপনি কি আবদুল মুত্তালিবের ধর্ম ত্যাগ করবেন?” নবিজি (সা) আবু তালিবকে কালেমা পড়ার জন্য বারবার অনুরোধ জানালেন। অন্যদিকে তারা (আবু জেহেল ও আবদুল্লাহ ইবনে আবি উমাইয়া) প্রতিবারই তাদের কথার পুনরাবৃত্তি করে গেল। শেষ পর্যন্ত আবু তালিব আবদুল মুত্তালিবের ধর্মে থাকার ইচ্ছা ব্যক্ত করে কালেমা না পড়েই মারা গেলেন। নবিজি (সা) বললেন, “আমি আল্লাহর কাছে আপনার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করব যতক্ষণ পর্যন্ত আল্লাহ আমাকে তা করা থেকে বিরত না করেন।” এখানে উল্লেখ্য, নবি-রসুলের মূল দায়িত্ব আল্লাহ তায়ালার আদেশ পালন করা। সাধারণভাবে নবিগণ যা করতে চান তা করার সিদ্ধান্ত তাঁরা নিজেরা নেন।

না, আল্লাহর আদেশের অপেক্ষায় থাকেন। নবিজি (সা) সাধারণত তা-ই করতেন। কিন্তু প্রিয় চাচা আবু তালিবের মৃত্যুতে তিনি অত্যধিক শোকবিহ্বল হয়ে আল্লাহ তায়ালার অনুমতি ছাড়াই আবু তালিবকে ক্ষমা করার জন্য অনুরোধ করার ইচ্ছা ব্যক্ত করেন। এই প্রেক্ষিতে আল্লাহ কোরানের আয়াত নাজিল করার মধ্য দিয়ে তাঁর রসুলকে (সা) জানিয়ে দেন: “আত্মীয়স্বজন হলেও মুশরিকদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করা নবি ও মুমিনদের জন্য সংগত নয় যখন এটা সুস্পষ্ট যে ওরা জাহান্নামে বাস করবে।”

 

islamiagoln.com google news
আমাদের গুগল নিউজে ফলো করুন

 

[সুরা তওবা, ৯:১১৩] এরপর নবিজি (সা) আবু তালিবের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা থেকে বিরত হলেন। আল্লাহ তায়ালা এবার আরেকটি আয়াত নাজিল করলেন: “কাউকে প্রিয় মনে করলেই তুমি তাকে সৎপথে আনতে পারবে না; তবে আল্লাহ যাকে ইচ্ছা সৎপথে আনেন, আর তিনিই ভালো জানেন কারা সৎপথ অনুসরণ করে।” [সুরা কাসাস, ২৮:৫৬] সুনানে আবু দাউদের অন্য একটি হাদিসে আছে, আলি ইবনে আবি তালিব প্রথম ব্যক্তি যিনি নবিজিকে (সা) আবু তালিবের মৃত্যুসংবাদ দেন। এ থেকে ধারণা করা যায়, নবিজি (সা) আবু তালিবের সঙ্গে তাঁর মৃত্যুশয্যায় দেখা করেছিলেন, কিন্তু আবু তালিব মারা যাওয়ার মুহূর্তে তিনি সেখানে ছিলেন না। আলি এসে নবিজিকে (সা) বলেন, “আপনার চাচা মারা গেছেন।” অন্য একটি বর্ণনা অনুসারে আলি বলেছিলেন, “আপনার পথভ্রষ্ট চাচা মারা গেছেন।” এ থেকে বোঝা যায়, আলি তাঁর পিতার ইসলাম গ্রহণ না করায় অসন্তুষ্ট ছিলেন।

নবিজি (সা) আলিকে বললেন, “যাও এবং তাঁকে দাফন করো।” আলি বললেন, “কিন্তু তিনি তো একজন মুশরিক হিসেবে মৃত্যুবরণ করেছেন।” নবিজি (সা) আবারও বললেন, “যাও এবং তাঁকে দাফন করো। দাফন শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ফিরে এসো। পথে কিছু করবে না।” সুতরাং আলি গিয়ে তাঁর পিতাকে কবর দিয়ে ফিরে এলেন। তাঁর শরীরে অনেক ধুলোমাটি জমে ছিল। নবিজি (সা) আলিকে মানসিকভাবে সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য একটি দীর্ঘ দোয়া করেন।

 

আবু তালিবের মৃত্যু | খাদিজা (রা) ও আবু তালিবের মৃত্যু | মহানবী হযরত মুহাম্মদ ( সাঃ ) জীবন

 

আবু তালিবের মৃত্যুর আগের আরেকটি ঘটনা ঘটেছিল বলে জানা যায়। আবু জেহেল, উতবা ইবনে উমাইয়া প্রমুখ গিয়ে আৰু তালিবকে বলল, “আপনি তো এখন মারা যাচ্ছেন; এখনই এই বিরোধের সমাধান করে যান, না হলে গৃহযুদ্ধ লেগে যাবে।” জানা যায় যে, আবু তালিব মারা যাওয়ার আগে কুরাইশরা আরও একবার চেষ্টা করেছিল। এবার তারা আবু তালিবের কাছে শর্ত নিয়ে এল “আমরা তাঁকে হত্যা করব না। তবে আপনি শুধু নিশ্চিত করুন যে তিনি যেন নিজের চরকায় তেল দেন। আর আমরাও আমাদের মতো থাকব।

নবিজি (সা) যখন আবু তালিবের কাছে এলেন, তখন আবু জেহেল ও আবদুল্লাহ ইবনে আবি উমাইয়া সেখানে উপস্থিত। আবু তালিব তাঁর ভাতিজা মুহাম্মদকে (সা) বললেন, “আমার লোকেরা আমাকে ঘিরে ধরেছে। তুমি তাদের অন্তত একটা শর্ত মেনে নাও। তুমি যা ইচ্ছা করো, শুধুমাত্র তাদের বিষয়ে হস্ত ক্ষেপ করবে না (অর্থাৎ তুমি তাদের দেবতাদের উপহাস করবে না, কেবল নিজেকে নিয়েই থাকবে)।”

নবিজি (সা) জবাবে বললেন, “আমি এই কথা রাখব যদি তারা আমাকে কেবল একটি কথা (কালেমা) দেয়”। আর আমি প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি, সময় আরব সাম্রাজ্য তাদের হবে।” আবু জেহেল বলল, “আমরা তোমাকে দশটি কথা (কালেমা) দেব! তুমি কী চাও?” তখন নবিজি (সা) বললেন, “আপনাদের কাছ থেকে আমি যে একটি কালেমা চাই তা হলো ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’। আমাকে আপনারা এই কালেমা দিন, আপনারা পুরো আরব অঞ্চলকে নিয়ন্ত্রণে রাখবেন। * আবু জেহেল সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠল, “কক্ষনো না!” জানা যায় যে, ঠিক তখনই নবিজি (সা) আবু তালিবের দিকে ফিরে বলেছিলেন, “হে আমার চাচা! আপনি কেবল বলুন, ‘আল্লাহ ছাড়া আর কোনো উপাস্য নেই’, যাতে আমি আল্লাহর দরবারে আপনার জন্য সুপারিশ করতে পারি।”

ইবনে ইসহাকের বর্ণনা অনুসারে, কুরাইশরা চলে যাওয়ার পরে আবু তালিব নবিজিকে (সা) বলেন, “আমি যদি কালেমা পড়তাম তাহলে আমার সম্প্রদায়ের লোকেরা এই বলে আমাকে দোষারোপ করত যে আমি মারা যাওয়ার সময় ভয়ে তোমার ধর্ম গ্রহণ করেছি।” ব্যাপারটা সত্যিই দুঃখজনক, কারণ আবু তালিব ভালো করেই জানতেন যে তাঁর ভাতিজা একজন সত্য নবি। তিনি তাঁর একটি কবিতায়ও লিখেছেন, “অবশ্যই মুহাম্মদের ধর্ম সকল ধর্মের মধ্যে সেরা। যদি মানুষ আমার সমালোচনা না করত, তাহলে আমি তা গ্রহণ করতাম।”

বহু বছর পরে আবু তালিবের ছোট ভাই আব্বাস নবিজিকে (সা) জিজ্ঞেস করেছিলেন, “হে আল্লাহর রসুল! আপনি কি আপনার চাচার (আবু তালিবের) কোনো উপকার করতে পেরেছেন? তিনি আপনাকে রক্ষা করেছেন, আপনার পক্ষ হয়ে অন্যদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন।” নবিজি (সা) উত্তরে বলেছিলেন, “হ্যাঁ, আমি তাঁর উপকার করতে পেরেছি। কেবল আমার জন্যই তিনি জাহান্নামের আগুনের একদম প্রান্তসীমায় রয়েছেন। না হলে তিনি জাহান্নামের আগুনের গভীরে নিমজ্জিত থাকতেন। সহিহ মুসলিমের একটি হাদিসে নবিজি (সা) বলেন, “নরকের আগুনের চিরস্থায়ী বাসিন্দাদের মধ্যে যে ব্যক্তি সবচেয়ে কম শাস্তি পাচ্ছেন তিনি হচ্ছে আবু তালিব ।”

আরো পড়ূনঃ

Leave a Comment