ইসলাম-পূর্ব আরবে পৌত্তলিকতার ইতিহাস | ইসলাম-পূর্ব বিশ্বে ধর্মীয় পরিস্থিতি | মহানবী হযরত মুহাম্মদ সাঃ জীবন

ইসলাম-পূর্ব আরবে পৌত্তলিকতার ইতিহাস | ইসলাম-পূর্ব বিশ্বে ধর্মীয় পরিস্থিতি, আরবদের নবি ছিলেন ইব্রাহিম (আ), যিনি তাদেরকে ‘তওহিদ’ বা একেশ্বরবাদের দীক্ষা দিয়েছিলেন। এক্ষেত্রে প্রশ্ন উঠতে পারে, তাহলে সেখানে পৌত্তলিকতা কোথা থেকে এসেছিল? আল্লাহর রসুল (সা) আমাদের জানিয়েছেন কখন, কোথায় এবং কীভাবে আরব ভূখণ্ডে পৌত্তলিকতা শুরু হয়েছিল। আমর ইবনে লুহাই আল খুজা নামের এক ব্যক্তি হজরত ইসমাইলের (আ) ধর্মে পরিবর্তন এনেছিল এবং প্রথম ওই অঞ্চলে কুসংস্কারের প্রবর্তন করেছিল।

 

 

ইসলাম-পূর্ব আরবে পৌত্তলিকতার ইতিহাস | ইসলাম-পূর্ব বিশ্বে ধর্মীয় পরিস্থিতি | মহানবী হযরত মুহাম্মদ সাঃ জীবন

 

ইসলাম-পূর্ব আরবে পৌত্তলিকতার ইতিহাস | ইসলাম-পূর্ব বিশ্বে ধর্মীয় পরিস্থিতি | মহানবী হযরত মুহাম্মদ সাঃ জীবন

আল্লাহ পবিত্র কোরানে বলেছেন: বহিরা, সায়েরা, ওসিলা ও হাম-এর কোনোটাই কিন্তু আল্লাহ তায়ালা বালিয়ে দেননি; বরং কাফেররাই (কুসংস্কার দিয়ে) আল্লাহর ওপর মিথ্যা আরোপ করে।” [সুরা মায়িদা, ৫:১০৩] জানা যায়, আমর ইবনে লুহাই ছিল আরবের মক্কা অঞ্চলের অধিবাসী। সে একবার সিরিয়া ভ্রমণ করেছিল যেখানে আমালিক (লম্বা লোকদের একটি উপজাতি) বাস করত। আমালিকদের মধ্যে আমর একটি পরাক্রমশালী সভ্যতা দেখতে পেয়েছিল। আমালিকরা মূর্তিপূজা করত। সে তাদের জিজ্ঞেস করল, যে পুজা করছ, এই মূর্তিগুলো কী?” জবাবে তারা তাকে বলেছিল, এগুলো আমাদের শক্তির উৎস।

যখনই আমরা খরা বা দুর্ভিক্ষে পতিত হই, অথবা শত্রু দ্বারা আক্রান্ত হই, তখনই আমরা এই প্রতিমাগুলোর কাছে প্রার্থনা করি, এবং অলৌকিকভাবে ফল পাই।” আমর বলল, “তোমরা কি আমাকে এর মধ্যে একটি উপহার হিসেবে দিতে পারো?” একথা শুনে তারা তাকে ‘হুবাল’ নামের একটি প্রতিমা উপহার হিসেবে দিল, যা আমর মক্কায় নিয়ে এসেছিল। এভাবেই এটি আরব উপদ্বীপের প্রথম এবং কুরাইশদের মূল প্রতিমা হয়ে উঠেছিল। আমর ইবনে লুহাই উপহার হিসেবে পাওয়া সেই প্রতিমাটি এনে কাবার সামনে স্থাপন করে। সেই সময় থেকেই ওই অঞ্চলে পৌত্তলিকতার শুরু। আমর ইবনে লুহাই হলের তালবিয়াতেও পরিবর্তন এনেছিল। মূল তালবিয়া ছিল, ‘লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইকা লাব্বাইকা লা শারিকা লাকা লাব্বাইক।

অর্থাৎ ‘আমি হাজির, হে আল্লাহ, আমি হাজির আমি এখানে হাজির, আপনার কোনো অংশীদার নেই, আমি এখানে হাজির। আমর ইবনে লুহাই এটিকে পরিবর্তন করেছিল এভাবে: “লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক! লাব্বাইকা লা শারিকা লাক ইয়া শারিকান হুয়া লাক তামলিকুহু ওয়া মা মালাক।” অর্থাৎ “আমি হাজির, হে আল্লাহ, আমিই হাজির। আমি এখানে হাজির, আপনার একজন অংশীদার ছাড়া কোনো অংশীদার নেই, যে আপনারই, এবং আপনি তাকে এবং সে যেসবকিছু নিয়ন্ত্রণ করে তাও নিয়ন্ত্রণ করেন।” যার মূল অর্থ হলো, হে আল্লাহ, আপনার অংশীদার রয়েছে তবে আপনিই ‘বিগ বস’ ।

 

islamiagoln.com google news
আমাদের গুগল নিউজে ফলো করুন

 

আমর ইবনে লুহাইয়ের প্রচলন করা এই নতুন তালবিয়া প্রকারান্তরে এক নতুন ধর্মেরও প্রচলন করেছিল। তবে কারও কারও মতে আমর ওই নতুন তালিবিয়ার প্রচলন করেনি। আরও কয়েক প্রজন্ম পরে অন্য কিছু লোক এর প্রচলন করেছিল। প্রশ্ন আসতে পারে, আমর ইবনে লুহাই কোন সময়কালে বেঁচে ছিলেন? এর উত্তর আমরা কখনই সুনির্দিষ্টভাবে জানতে পারব না; কারণ আরবদের কাছে সন-তারিখের আসল হিসেব ছিল না। তারা সাল বা তারিখের কোনো রেকর্ড রাখত না।

তারা বিভিন্ন বড় বড় ঘটনা বা উপলক্ষ্য দিয়ে সময়কালের উল্লেখ করত। যেমন, ‘হাতির বছর’ (অর্থাৎ যে বছর হাতি আক্রমণ করেছিল), ‘অমুক যুদ্ধের দুই বছর আগে’, ‘হাতির আক্রমণের তিন বছর পরে ইত্যাদি। তাদের নিজেদের যেমন কোনো ক্যালেন্ডার ছিল না, তেমনই তারা রোমান, পার্সিয়ান কিংবা ইহুদিদের ক্যালেন্ডারগুলোও ব্যবহার করত না। উমরই (রা) প্রথম আরব অঞ্চলে ক্যালেন্ডারের প্রবর্তন করেন।

 

ইসলাম-পূর্ব আরবে পৌত্তলিকতার ইতিহাস | ইসলাম-পূর্ব বিশ্বে ধর্মীয় পরিস্থিতি | মহানবী হযরত মুহাম্মদ সাঃ জীবন

 

আমর ইবনে লুহাইয়ের সময়কাল সঠিকভাবে আমাদের পক্ষে জানা সম্ভব না হলেও এটি জানা যায় যে আমর কুরাইশ সম্প্রদায়ের প্রতিষ্ঠাতা ফিহরের সমসাময়িক। তাই ধারণা করা যেতে পারে যে, আমর খ্রিষ্টীয় প্রথম শতাব্দীতে বেঁচে ছিল। সেই হিসেবে এও বলা যায় যে, মহানবি মুহাম্মদের (সা) জন্মের ৫০০ বছরেরও কিছু বেশি সময় আগে থেকে আরব ভূখণ্ডে পৌত্তলিকতা ছড়িয়ে পড়েছিল। এখানে আরেকটি প্রশ্ন আসতে পারে, একজন মানুষ কীভাবে একাই তাদের পূর্বপুরুষ ইব্রাহিম (আ) ও ইসমাইলের (আ) প্রবর্তিত এত বছরের পুরনো ধর্মে পুরোপুরি পরিবর্তন আনতে পেরেছিল? এর উত্তরে তিনটি কারণ উল্লেখ করা যেতে পারেঃ

১) আমালিকদের পরাক্রমশালী সভ্যতা (তাদের ইতিহাস, সাহিত্য, স্থাপত্য, বড় বড় অট্টালিকা, উন্নত জীবনযাত্রা, শৌর্যবীর্য ইত্যাদি) দেখে আমর ইবনে লুহাইয়ের মনে এক ধরনের হীনম্মন্যতাবোধ জন্ম নিয়েছিল। তাদের জৌলুসপূর্ণ জীবনযাপন দেখে তার মনে হয়েছিল, আমালিকদের নিশ্চয়ই সবকিছু সঠিক। আমর ধরেই নিয়েছিল তারা ধর্মের দিক থেকেও নিশ্চয়ই সঠিক পথে আছে। এই ধারণা থেকে সে তাদের থিওলজি বা ধর্মতত্ত্ব গ্রহণ করেছিল।

২) আমর ছিল তার সম্প্রদায়ের মধ্যে বেশ প্রভাবশালী। সে ছিল খুজা সম্প্রদায়ের অন্যতম প্রভাবশালী নেতা। একজন উদার প্রকৃতির মানুষ হিসেবে সে তার সম্প্রদায়ের সবার কাছে শ্রদ্ধাভাজন ছিল। তাছাড়া নেতা হিসেবে বিভিন্ন যুদ্ধে জয়ী হওয়ায় সে তার লোকদের কাছে এক উচ্চতর মর্যাদাপূর্ণ আসনে অধিষ্ঠিত ছিল। ফলে খুজা সম্প্রদায় যে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য মক্কার দেখভালের দায়িত্বে ছিল, তখনই সেখানে মূর্তিপূজা ছড়িয়ে পড়ে।

৩) আমর ইবনে লুহাই ও ইব্রাহিমের (আ) মধ্যে সময়ের ব্যবধান ছিল। কমপক্ষে দুই হাজার বছর। সেই দীর্ঘ সময়কালে ওই অঞ্চলে ধর্মীয়ভাবে তেমন কোনো দিক-নির্দেশনা ছিল না, বরং এক ধরনের অজ্ঞতার পরিবেশ বিরাজ করছিল। এ বিষয়ে আরেকটি কাহিনি প্রচলিত আছে। শয়তান আমর ইবনে লুহাইকে স্বপ্নের মধ্যে প্রথম যুগের প্রতিমাগুলোর নাম দিয়ে অনুপ্রাণিত করেছিল। প্রসঙ্গক্রমে নুহের (আ) সময় থেকে পাঁচজন ধার্মিক ব্যক্তির নামে চলে আসা পাঁচটি প্রতিমার উল্লেখ করা যায়: ওয়াদ্দ, সুওয়া, ইয়াম্বুথ, ইয়াউক এবং নাসর।

এই নামগুলো পবিত্র কোরানেও উল্লেখ আছে। ইবনে আব্বাস (সা) নুহের (আ) সময়কালের এই পাঁচজন ধার্মিক ব্যক্তির কাহিনি উল্লেখ করেছেন, যাদের মৃত্যুর পর সেখানকার লোকেরা তাদের কীর্তি স্মরণে রাখার জন্য প্রতিমা তৈরি করেছিল। কয়েক প্রজন্ম যেতে না যেতেই লোকেরা তাদের সেই প্রতিমাগুলোর পূজা শুরু করে। শয়তান এই পাঁচ ব্যক্তির ধার্মিকতাকে মানুষের জন্য মূর্তিপূজা শুরুর প্রাথমিক ধাপ হিসেবে ব্যবহার করেছিল। তাই বলা হয়ে থাকে, শয়তানই আমর ইবনে লুহাইকে এই পাঁচটি প্রতিমা পুনস্থাপিত করতে উদ্বুদ্ধ করেছিল। প্রাক-ইসলামি আরবে ওইসব প্রতিমার পূজা করা হলেও হাজার বছরেরও বেশি সময়ের ব্যবধানে মানুষেরা তাদের নাম ভুলে গিয়েছিল। কিন্তু আমর ইবনে লুহাই তাদের ফিরিয়ে আনে। তারপর থেকে একেক গোত্রের জন্য একেকটি প্রতিমার পূজা করার প্রচলন শুরু হয়।

আরো পড়ুনঃ

 

Leave a Comment