ইসলামের ইতিহাস সংক্ষিপ্ত [ Short History of Islam ] : বিশ্বের সর্ববৃহৎ ছয়টি ধর্মের মধ্যে সময়ের দিক থেকে সর্বকনিষ্ঠ, কিন্তু অনুসারীদের সংখ্যার দিক থেকে তৃতীয় বৃহৎ ধর্ম হচ্ছে ইসলাম। বর্তমান বিশ্বে মুসলমানদের সংখ্যা প্রায় একশত পঞ্চাশ কোটি এবং দেশ হিসেবে এশিয়া ও আফ্রিকা মহাদেশ ব্যাপী বিশাল এলাকায় বিস্তৃত ৫৭টি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশের কথা বাদ দিলেও বিশ্বের অবশিষ্ট প্রায় সকল দেশেই কমবেশী ইসলামের অনুসারী রয়েছে। খ্রিষ্ট ধর্মের প্রায় ছ’শত বছর পরে ইসলাম ধর্মের আবির্ভাব। আরবের মক্কা নগরে কোরেশ বংশে জন্ম নেয়া বিশ্বের সর্বাধিক সফল এবং প্রভাবিত মহামানব হজরত মুহম্মদ স. (৫৭০ (৬৩৩) ৬১৩ খ্রিষ্টাব্দে তিনি এই ধর্ম প্রচার করেন।
![ইসলামের ইতিহাস সংক্ষিপ্ত [ Short History of Islam ] 2 ইসলামের ইতিহাস সংক্ষিপ্ত [ Short History of Islam ]](http://www.islamiagoln.com/wp-content/uploads/2021/11/Mosque-Islam-Muslim-300x150.jpg)
ইসলামের ইতিহাস সংক্ষিপ্ত [ Short History of Islam ]
পবিত্র হেরা গুহায় আল্লাহর ধ্যান
আরবে তখন চলছিল অজ্ঞতা, কুসংস্কার ও শোষণ ও নিপীড়নের এক অন্ধকার যুগ যাকে ‘আইয়ামে জাহেলিয়াত’ বলা হয়। আরবের সমাজব্যবস্থা ও ধর্মীয় জীবন নিয়ন্ত্রিত হত বহু দেবদেবীর দ্বারা। মক্কার মূল উপাসনাগারে ছিল ৩৬০টি দেবদেবীর মূর্তি। একেকটি মূর্তি একেকটি গোষ্ঠীর ভাগ্যের প্রতিরূপে চিহ্নিত হত। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল লাত, মানাত ও উজ্জা। এই অন্ধকার থেকে মুক্তির উপায় সন্ধানকল্পে হজরত মুহম্মদ (দ.) পবিত্র হেরা গুহায় আল্লাহর ধ্যানে আত্মনিয়োগ করেন।
ধ্যানমগ্ন অবস্থায় ৪০ বছর বয়সের সময় তিনি স্বর্গীয় দূত জিবরাইলের মাধ্যমে আল্লাহর ঐশী বাণী বা ‘ওহী’ প্রাপ্ত হন। এই ঐশী নির্দেশাবলিই পরবর্তীকালে ইসলাম ধর্মের মূল বিধান হিসেবে গ্রন্থাকারে পবিত্র কুরআন হিসেবে সন্নিবেশিত হয়। কুরআন নাজিল হয় ৬১০ খ্রিষ্টাব্দে মক্কার হেরা পর্বতের গুহায়। একদা গভীর নিশীথে ২৭ রজমান (৬১০ খ্রি.) পারান পর্বতের ‘হেরা’ নামক গুহায় হজরত মুহম্মদ (স.) স্বর্গীয় দূত হজরত জিব্রাইলের সাক্ষাৎ লাভ করেন।
জিব্রাইল (আ.) তাঁকে স্বর্গীয় মহাগ্রন্থ কুরআনের আলাক’ সুরার প্রথম পাঁচটি শ্লোক শিক্ষাদান করে অন্তর্হিত হন। হজরত কম্পিত কলেবরে স্বগৃহে প্রত্যাবর্তন করেন এবং প্রিয়তমা সহধর্মিণী খাজিদা (রা.) এর নিকট আনুপূর্বিক সমস্ত ঘটনা বিবৃত করেন। খাদিজাই সর্বপ্রথম তাঁকে আল্লাহর ‘রসূল’ বলে বিশ্বাস জ্ঞাপন করেন। কিছুদিন পর হজরত (স.) আল্লাহর কাছ থেকে প্রাপ্ত প্রত্যাদেশ ও প্রিয়তমার উৎসাহবাক্যে অনুপ্রাণিত হয়ে ইসলাম ধর্ম প্রচার করতে থাকেন।
একরা বিসমে রাব্বেকাল লাজি খালাক:
আল্লার আদিষ্টে জিব্রাইল কর্তৃক এর প্রথম বাক্য ছিল : ‘একরা বিসমে রাব্বেকাল লাজি খালাক‘— অর্থাৎ ‘পড় তোমার প্রভুর নামে যিনি তোমাকে সৃষ্টি করেছেন।’ পরে আল কুরআনের ৯৬ নং সুরার প্রথম আয়াত (বাক্য) হিসেবে সংকলিত হয়। এর প্রথম শব্দের তাৎপর্য ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে ‘ইকরা’-যার অর্থ পড় (Read), পুনরাবৃত্তি কর (Repeat), তেলাওয়াত কর (Recite) অনুশীলন কর (Rehearse) এবং গবেষণা কর (Research)। 5 Rs তথা জ্ঞানার্জন কর।
কুরআন নাজিল হয় রমজান মাসের ২৭ তারিখে ‘লাইলাতুল কদর’-এর রাত্রিতে। হজরত মুহম্মদ (স.)-এর উপর যখন কুরআন নাজিল হয় তখন তার বয়স ৪০ বৎসর। নাজিলের সময়সীমা ছিল ১৩ বছর। সর্বমোট ১১৪টি সুরার ৯২ মক্কায় এবং ২২টি মদিনায় অবতীর্ণ হয়। এতে ৭টি মনজিল, ৩০টি পারা এবং ৪৫৮টি রুকুতে বিভক্ত হয়। কুরআন সংকলিত হয় ৬৫১ খ্রিষ্টাব্দে।
ইসলাম ধর্মের বিশ্বাস অনুযায়ী ‘মানুষ (আদিতে) ছিল একজাতি। পরে মানুষেরাই বিভেদ সৃষ্টি করল। অতঃপর আল্লাহ নবীগণকে সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারীরূপে প্রেরণ করেন; এবং মানুষের মধ্যে যে বিষয়ে মতভেদ সৃষ্টি হয়েছিল, তার মীমাংসার জন্য তিনি সত্যসহ কিতাব অবতীর্ণ করেন, এবং যাদের তা দেওয়া হয়েছিল, স্পষ্ট নিদর্শনাদি তাদের নিকট আসার পর তারা শুধু পরস্পর বিদ্বেষবশত বিরোধিতা করত।’ (সুরা বাকারা, আয়াত ২১৩)।
পবিত্র কুরআনে আরও বলা হয়েছে, যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসুলগণকে অবিশ্বাস করে আর ইচ্ছাকৃতভাবে আল্লাহ ও রাসুলদের মধ্যে পার্থক্য করে এবং বলে যে আমরা কতককে বিশ্বাস করি ও কতককে অবিশ্বাস করি এবং এদের মধ্যবর্তী এক পথ অবলম্বন করতে চায়। প্রকৃতপক্ষে এরাই অবিশ্বাসী এবং অবিশ্বাসীদের জন্য লাঞ্ছনাদায়ক শাস্তি প্রস্তুত রেখেছি।’ (সুরা নিসা, আয়াত ১৫০-১৫১)। অর্থাৎ সকল নবীকে মান্য করেও মাত্র একজনকেও যদি অস্বীকার করা হয়, তাহলে তা পূর্ণ বিশ্বাস বলে গণ্য হবে না। এই হিসেবে ইসলাম ধর্ম চরিত্রগতভাবে উদার ও অসাম্প্রদায়িক।
মদিনায় হিজরত:
৬২২ খ্রিষ্টাব্দে হজরত মহম্মদ (দ.) মক্কা থেকে মদিনায় হিজরত করার পর মদিনায় যে রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেন, তা-ও ছিল অসাম্প্রদায়িক। উক্ত রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পূর্বে মদিনার ইহুদী, খ্রিষ্টান, পৌত্তলিক ও মুসলমানদের মধ্যে যে আন্তঃসম্প্রদায় চুক্তি (যা ইসলামের ইতিহাসে ‘মদিনার সনদ’ নামে পরিচিত) সম্পাদিত হয়, তাতে বলা হয়: প্রত্যেক ব্যক্তি (সে ইহুদি হোক, খ্রিষ্টান হোক, সাবিয়্যিন হোক বা মুসলিম) তার নিজস্ব ধর্ম পালন করার অধিকার পাবে এবং রাষ্ট্রের মূল কাঠামো হবে গণতান্ত্রিক, সেখানে রাষ্ট্রপ্রধান নির্বাচিত হবেন সাধারণ জনগণ দ্বারা।
আর সংখ্যালঘুকে দেয়া হবে সংখ্যাগুরুর মতো সমস্ত অধিকার। মানবজীবনে যে সব মূল্যবানের সৃষ্টি হবে, তার আলোকে মানুষ তার জীবনে প্রতিটি ক্ষেত্র নিয়ন্ত্রণ করবে। সাম্য, মৈত্রী, স্বাধীনতা, জাতির আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার কেউ কেড়ে নিতে পারবে না।’ (সা’দ উল্লাহ, প্রাগুক্ত)
ইসলাম ধর্মের অনুসারীদের মুসলিম নামে অভিহিত করা হয়। বর্তমানে ইসলাম ধর্মাবলম্বীর সংখ্যা পৃথিবীতে দ্বিতীয় স্থানে অবস্থান করছে যা ৮০০ মিলিয়নেরও অধিক। উত্তর আফ্রিকা থেকে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া পর্যন্ত বিস্তৃত ৪৫টি মুসলিম রাষ্ট্র ছাড়াও ইউরোপ মহাদেশে ৯ মিলিয়ন মুসলিম রয়েছে। নবম শতাব্দী থেকে ইসলামী শাসন ও সভ্যতার ক্রমবিকাশ শুরু হলে তা এশিয়া ও আফ্রিকা মহাদেশে বিস্তৃতি লাভ করে। ফলে এসকল মহাদেশে মুসলমানের সংখ্যাধিক্য ঘটে যা আরবদের সংখ্যাকেও ছাড়িয়ে যায়। একসময় মসলিম সম্প্রদায়ের আধিক্য দেখা যায় ইন্দোনেশিয়া, বাংলাদেশ ও পাকিস্তান ও ভারতে। এদেশগুলোর জনসংখ্যা সমগ্র আরব বিশেষ জনসংখ্যাকেও ছাড়িয়ে যায়।
ইসলাম শব্দটি ‘আসলামা’ শব্দ থেকে উৎপত্তি হয়েছে যার অর্থ হল শান্তি। আর ‘মুসলমান’ শব্দের অর্থ হল আত্মসমর্পণকারী। যিনি আল্লাহর নিকট সামগ্রিকভাবে আত্মসমর্পণ (To surrender) করেন তাকেই বলা হয় মুসলমান।
হজরত নূহের প্লাবনের পর কা’বা শরীফ পুনঃপ্রতিষ্ঠার দিন হজরত ইব্রাহীম, হজরত মুহম্মদের (সা.) জন্য প্রার্থনা করেছিলেন। এই সময়েই তিনি আল্লাহর নিকট সম্পূর্ণ আত্মসমর্পণ করেছিলেন এবং দুই পুত্রসহ (ইসমাইল ও ইসহাক) উভয়কেই ‘মুসলিম’ (আত্মনিবেদিত) বলে ঘোষণা করেছিলেন। এই ঘোষণা বাণী থেকেই ইব্রাহীমের বংশধরগণ মুসলিম বা মুসলমান বলে পরিচিত হন।
‘কোরআন’ ইসলাম ধর্মের পবিত্র গ্রন্থ। Encyclopaedia of Britannica গ্রন্থে এর অর্থ করা হয়েছে ‘কোর’ মানে পড়া; ‘আন’ অর্থ সর্বক্ষণ বা নিত্য। আভিধানিক দিক থেকে কোরআন-এর অর্থ হল ‘নিত্য পাঠ কর। কলেমা, নামাজ রোজা, হজ্ব ও জাকাত- এই পাঁচটি ইসলাম ধর্মের মূল স্তম্ভ।
কোরআন উৎপত্তির প্রেক্ষিতে সম্পর্কে ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, মরু ভাস্কর হজরত ছিলেন স্বীয় পত্নী খাদিজার দূরসম্পর্কীয় আত্মীয় অরাকা-বিন নওফেল (যিনি তৌরাত ও ইঞ্জিল আরবিতে অনুবাদ করেছিলেন) এর প্রত্যক্ষ ছাত্র। এখান থেকেই তিনি জানতে পারেন সৃষ্টি জগতের তত্ত্ব; দর্শন, সমাজ ও জীবনাচারের খুঁটিনাটি। এছাড়া বাল্যকাল হতে মোহাম্মদ সেমিটিক জনপদের একাধিক স্থানে ভ্রমণ করেন। এই ভ্রমণের সময় তার প্রথম সাক্ষাৎ হয় নেষ্টরীয় খ্রিষ্টান পণ্ডিত ‘বহিরা’র সাথে। এই সাক্ষাতের মাধ্যমেই তিনি সত্যকার পরিচয় পান খ্রিষ্টান ধর্মের গূঢ় রহস্যের।
এ সময় দূর দূরান্তের ব্যবসায়িক কাফেলায় ও অসংখ্য আলোচনার টেবিলে অংশ নেন তিনি। মোহাম্মদ যথার্থই অনুধাবন করেন; আর তা হল, সকল বিষয়েই উন্নত অভিজাত আরব জাতির একটিই দুর্বলতা ‘একজন নবী এবং পবিত্র গ্রন্থ’র অভাব। কেননা আলোচনার টেবিলে অন্যেরা যখন তাদের নবী ও পবিত্র গ্রন্থের উদ্ধৃতি ব্যবহার করতেন আরবরা তখন মুখ হয়ে যেতেন। মোহাম্মদ সে কারণে আরব জাতির অপরাপর সমস্যার পাশাপাশি ওই রাজনেতিক-সাংস্কৃতিক সমস্যা সমাধানের জন্য জীবনের প্রতিমুহূর্তে চিন্তিত থাকতেন; ভাবতেন, নির্জনে-নীরবে-নিভৃতিতে ধ্যানে বসতেন।
অবশেষে মোহাম্মদ একটি ঐতিহাসিক প্রয়োজনকে বাস্তবায়িত করলেন। ইসলামের মত একটি ধর্মের, একটি বৃহৎ আদর্শের জন্ম দিলেন। মোহাম্মদ তিনি এ কাজে এগিয়ে না এলে অন্য কেউ অবশ্যই এগিয়ে আসতেন। সমাজ সংস্কারক অথবা ধর্ম প্রচারক অথবা আরব সংগঠকের জায়গা দখল করতেন, কেননা তা ছিল ঐতিহাসিক প্রয়োজন। মোহাম্মদ সেই সময়কার সচেতন আরবদেরই একজন প্রতিনিধি। এভাবেই ৪০ বছর বয়সে নবী ওহি প্রাপ্ত হন। কথিত আছে, ওহি নাজেল হত কাবিলা মাজারদের ভাষায়। এই ভাষা ছিল হজরতের পৈত্রিক ভাষা। ‘মাজার’ ছিলেন হজরতের পরদাদাদের একজন। তাঁর নামানুসারেই গোত্রের নাম হয়েছে কাবিলা মাজার। এই কাবিলা মাজারের ভাষাই ছিল কোরাইশদের ভাষা; মূলত তা ছিল আরবেরই একটি আঞ্চলিক ভাষা। কিন্তু কোরআন ভাষ্যকাররা বলে থাকেন, তা ছিল আল্লাহর ভাষা।
ইসলাম ধর্ম বিশেষত সিমেটিক (Semetic) এবং এমন কি আরবীয় চরিত্রটিকে প্রকাশ করেছে। আল্লাহ সর্বশক্তিমান, তিনি সৃষ্টিকর্তা। তিনি সবকিছু করেন, করান— এই ধারণা ইসলাম ধর্মকে একেশ্বরবাদী করেছে। ইসলামে সম্পূর্ণরূপে আল্লাহর একত্ব সার্বভৌমত্বকে স্বীকার করা হয়েছে। ভারতীয় চার্বাক দর্শনের মত ইসলামে ভোগের প্রাধান্য খুব বেশি। ত্যাগের কথা বলা হলেও সেই ত্যাগ-মহিমা বৌদ্ধ বা খ্রিষ্ট ধর্মের মত নয়।
বিভক্তি:
ইসলাম ধর্ম শিয়া-সুন্নি এ দুটি ভাগে বিভক্ত। পরবর্তীকালে সুফি, আশারিয়া, কাদেরিয়া, জাকারিয়া এবং মুতাজিলা ইত্যাদি এই সকল ধর্ম সম্প্রদায়ের ইসলাম বিভক্ত হয়ে পড়ে। আধুনিক যুগে ইসলামের আরও দুটি শাখার সৃষ্টি হয়েছে। একটি বাহাই সম্প্রদায়, অন্যটি আহমদিয়া সম্প্রদায়।
আহমদীয়া মুসলিম জামাতের প্রতিষ্ঠাতা মির্যা গোলাম আহমদ (১৮৩৫-১৯০৮)। তিনি কোরআনে উল্লিখিত হজরত মহম্মদ (স.) কে ‘খাতামাল আম্বিয়া’ শব্দের অর্থ শেষ নবী অর্থে অনুসরণ না করে নবীদিগের মোহর (সকল নবী থেকে শ্রেষ্ঠ) অর্থে অনুসরণ করার নির্দেশ দেন। পূর্ব পাঞ্জাবের কাদিয়ান অঞ্চলে জন্ম বলে তিনি মির্যা গোলাম আহমদ কাদিয়ানী নামে পরিচিত। তাঁর রচিত গ্রন্থের নাম কিশতিয়ে নূহ। তিনি মনে করেন ওহির দরজা এখনও খোলা আছে। তাঁর অনুসারীরা তাঁকে প্রতিশ্রুত মসীহ ও ইমাম মাহদী (আ.) হিসেবে দাবি করেন। মির্জা গোলাম আহমদ এর অনুসারিরা নিজেদের ‘আহমদীয়া আল জামাত’ নামে পরিচয় দেন। তবে মুসলিম সমাজের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ এদের ‘কাদিয়ানী’ নামে চিহ্নিত করে। বাংলাদেশে ঢাকার বকশী বাজারে আহমদীয় আল জাতাম এর প্রধান কার্যালয় অবস্থিত।
এছাড়াও বিশ্বের বিভিন্ন জনপদের অনুশাসনে অনুসৃত হানাফী, শাফেয়ী, মালেকী ও হাম্বলী নামে চারটি মযহাব (School of Thoughts)। আরও আছে আহলে সুন্নাত আল জামাত। আছে আহলে হাদীস অনুসারিবৃন্দ।
আহলে হাদীস কথাটি ফার্সি ও উর্দু সম্বন্ধপদ। মূলত আরবী ভাষা ‘আহলুল হাদীস’ থেকে এর উৎপত্তি হয়েছে। আহলে হাদীস ও আহলুল হাদীস উভয় উচ্চারণের অর্থ একই হয়। আহলুন শব্দের অর্থ বংশধর বা অনুসারী। আর হাদীস অর্থ কথা বা বাণীকে হাদীস বলা হয়। তাই আহলে হাদীস অর্থ হচ্ছে হাদীসের অনুসারী।
অনেকে মনে করেন রসুল (স.)-এর কথা বা কাজকেই শুধু হাদীস বলে। অথচ আল্লাহ নিজের কুরআন মাজীদে তাঁর কথাকে হাদীস বলেছেন। যেমন : আল্লাহু নায্যালা আস্সানাল হাদীস। অর্থাৎ আল্লাহ অতি উত্তম হাদীস অর্থাৎ কুরআন। (সুরা যুমার-২৩ নং আয়াত) অন্য আয়াতে আছে- আফারিমন হা-যাল হাদীসি তা’জাবউন। অর্থাৎ তোমরা কি এই হাদীস তথা কুরআন শুনে আশ্চর্যবোধ করছ? (সুরা : আন্নজম ৫৯ নং আয়াত) এরূপভাবে মোট ১৪টি আয়াতে কুরআন তথ্য আল্লাহর কথাকে হাদীস বলা হয়েছে। যারা কুরআন ও হাদীসকে সরাসরি অনুসরণ করে তারাই আহলে হাদীস। কুরআন ও সুন্নাহ বা ইসলাম যাদের মাযহাব (চলার পথ) তারাই আহলে হাদীস।
মানুষের ইচ্ছার স্বাধীনতা এবং আল্লাহর সর্বশক্তিময়তা বা যথেচ্ছাচারিতার ব্যাপারে ইসলামের মধ্যে মতপার্থক্য বা যথেচ্ছাচারিতার ব্যাপারে ইসলামের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। মুতাজিলাবাদীরা মানুষের স্বাধীনতা এবং আল্লাহর শক্তি ও স্বরূপের মধ্যে ঐক্য স্বীকার করেন। তাঁদের মতে, মানুষের ইচ্ছার স্বাধীনতা আছে, আছে স্বাধীন চিন্তা ক্ষমতা। তাছাড়া আল্লাহ ন্যায়পরায়ণ, তিনি পাপাচারীকে কখনও ক্ষমা করেন না। কিন্তু রক্ষণশীল মুসলিমেরা এই মতের তীব্র বিরোধিতা করেন। বৌদ্ধ ধর্মের সঙ্গে এখানে একটা বড় মিল খুঁজে পাওয়া যায়। ইচ্ছার স্বাধীনতা, কর্মের স্বাধীনতা বৌদ্ধ ধর্মকে বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত করেছে।
ইসলাম বিশ্বের নবীনতম ধর্ম হওয়াতে প্রাক্ অথবা অন্য ধর্মসমূহ হতে অনেক দর্শন, ধর্মতত্ত্ব, নীতি, মতবাদ এবং উপদেশ পরোক্ষ অথবা প্রচ্ছন্নভাবে গ্রহণ করেছে। বৌদ্ধ ধর্মের অনেক নীতি বা আদর্শ ইসলাম ধর্মে দেখা যায়। যেমন— বৌদ্ধ ধর্মের পঞ্চশীল ইসলামের পাঁচটি মৌল বিষয়ে বিশ্বাস, বৌদ্ধ ধর্মের ত্রৈমাসিক উপবাসব্রত, ইসলামের একমাস রোজা উপবাসব্রত, বৌদ্ধ ধর্মের উপাসক পাসিকাকে প্রতি অষ্টমীতে সেখানে বিহার যাওয়ার কথা বলা হয়েছে, সেখানে ইসলামের বিধান হল প্রতি সপ্তাহের বলা হয়েছে। আবার কোন কোন ধর্মীয় বিধানকে উল্টোভাবে গ্রহণ করা হয়েছে। যেমন বৌদ্ধ ধর্ম ত্যাগের শিক্ষা, ইসলামে ভোগের শিক্ষা, বৌদ্ধ ধর্মে যুদ্ধ পরিহারের শিক্ষা, ইসলামে যুদ্ধ গ্রহণ করার শিক্ষা ইত্যাদি। ফানা-ফিল্লাহ এবং বাক্কা-বিল্লাহ ইসলামের চরম এবং পরম লক্ষ্য। এই লক্ষ্য অর্জনের জন্য ইসলামের অনুসৃত সর্বাধিক উদার মত সুফিবাদ।
ইসলামে শিয়া দর্শন:
শিয়া শব্দের অর্থ দল বা গোষ্ঠী। ইসলামের ইতিহাসে শিয়া হচ্ছে তাঁরাই যারা হজরত আলী (রা.) কে বিশেষভাবে অনুসরণ করে এবং তাঁর ইমামত ও খেলাফতকে হজরত মহম্মদ (সা.)-এর ইচ্ছা এবং তাঁরই শিক্ষাদানেরই ফলস্বরূপ মনে করে। কেননা শিয়ারা এই বিশ্বাসে বিশ্বাসী যে হজরত আলী (রা.) কে এজন্য অনুসরণ করতে হবে কারণ এটি হজরত মুহম্মদ (সা.) এর আদেশ ও তাঁরই ইচ্ছার বাস্তবায়ন, হজরত আলী (রা.)-এর ইচ্ছার নয়।
হজরত মুহম্মদ (সা.)-এর মৃত্যুর পর তাঁর স্থলাভিষিক্ত নির্ধারণকে কেন্দ্র করে হজরত আলীর সমর্থকদের দ্বারা শিয়ান-এ আলী’ নামে ইসলামে এই সমর্থক গোষ্ঠীর উদ্ভব ঘটে। পরবর্তীকালে এটি সংক্ষেপে ‘শিয়া’ নামে পরিচিতি লাভ করে। তাই ‘শিয়া’ শব্দের প্রকৃত ব্যাখ্যা হল : শিয়া হচ্ছে তারাই যারা হজরত আলী (রা.) কে অনুসরণ করে এবং তাঁকে হজরত মুহম্মদ (সা.) এর অব্যবহিত পরে তাঁর স্থলাভিষিক্ত হিসেবে মেনে থাকে। ইসলামের ইতিহাসে হজরত আলী (রা.)র চিন্তাদর্শনের অনুসারিরা একটি স্বতন্ত্র মাযহাব হিসেবে পরিগণিত হয়।
প্রকৃতপক্ষে হজরত আলী (আ.)-এর সমর্থকদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে হজরত আবু বকর (রা.) কে খলিফা নির্বাচিত করার ঘটনাকে কেন্দ্র করেই ইসলামে এই মাযহাবের সৃষ্টি হয়। কেননা হজরত আলীর (আ.) সমর্থকরা অর্থাৎ শিয়ারা মনে করেন হজরত মুহম্মদ (সা.)-এর স্থলাভিষিক্তর পদ একটি ঐশী পদ। যেরূপ হজরত মুহম্মদ (সা.) আল্লাহ তা’য়ালার পক্ষ থেকে মনোনীত হয়েছেন, সেইরূপ তাঁর স্থলাভিষিক্ত ও আল্লার পক্ষ থেকে মনোনীত এবং হজরত মুহম্মদ (সা.) মানুষের নিকট তাকে উপস্থাপন করবেন। যেহেতু শিয়া দৃষ্টিভঙ্গিতে হজরত আলী (আ.) হজরত মহম্মদ (সা.)-এর ঠিক পরবর্তী স্থলাভিষিক্ত।
উল্লেখ্য যে, হজরত মুহম্মদ (সা.)-এর জীবনাদর্শ যারা বিশেষভাবে অনুসরণ করেন এবং তাঁর মৃত্যু পরবর্তী চার খলিফা কর্তৃক ইসলামের সম্প্রসারিত নীতিমালা মেনে চলেন এঁরা সুন্নি মাযহারের অন্তর্গত। ইসলামে শিয়া ও সুন্নি মাযহাবের মধ্যে সর্বাধিক স্বাতন্ত্র্য বৈশিষ্ট্য হল শিয়ারা ইমামতের অনুসারি এবং সুন্নিরা রেসালতের অনুসারি।
[ ইসলামের ইতিহাস সংক্ষিপ্ত [ Short History of Islam ]]
সহায়ক গ্রন্থাবলি
- Shorter Encyelopedia of Islam: Leiden, 1960 Encyclopeadia of Religion and Ethics: Edinburgh, 1964 T. W. Arnold, Preaching of Islam, Oxford University Press, 1896 Fazlur Rahman, Islam: The University Press, Chicago, Illinois, USA 1966
- Syed Ameer Ali, The Spirit of Islam: Low Price Publications, Delhi, 1997
- গোলাম মোস্তফা, বিশ্বনবী; আহমদ পাবলিশিং হাউস, ঢাকা, একান্নতম মুদ্রণ ২০১৯
- মোহাম্মদ সফিউল আলম, কোরানের আলোকে স্রষ্টা ও সৃষ্টি; ইসলামিক পাবলিকেশন্স লিঃ; চট্টগ্রাম, ১৯৭৭ মোঃ জাকারিয়া কামাল, কোরআন ও বিজ্ঞানের আলোকে মানুষ ও
- মহাবিশ্বের সৃষ্টি রহস্য; আগামী প্রকাশনী, ঢাকা, প্র. প্র. ১৯৯২ মোহাম্মদ আকরম খাঁ, মোস্তফা-চরিত; ঝিনুক পুস্তিকা, ঢাকা, ১৯৬৭ ড. সৈয়দ কামাল আহমেদ, সৃষ্টির রহস্যে মানব; ফ্রেন্ডস বুক কর্নার, ঢাকা, ২০১৯
আরও পড়ুন: