দাওয়াতের বিভিন্ন পর্যায় | ব্যক্তিগত পর্যায়ে ইসলামের দাওয়াত, দাওয়াতকে পাচটি পর্যায়ে ভাগ করা যেতে পারে। মুসলিমরা পরিবেশ-পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে নিচে বর্ণিত যে কোনো পদ্ধতি ব্যবহার করলেই চলবে:
দাওয়াতের বিভিন্ন পর্যায় | ব্যক্তিগত পর্যায়ে ইসলামের দাওয়াত | মহানবী হযরত মুহাম্মদ ( সাঃ ) জীবন
১) ব্যক্তিগত দাওয়াত:
যদি আপনি খুব দুর্বল অবস্থানে থাকেন এবং যদি রাজনৈতিক পরিস্থিতি খুব বেশি প্রতিকূল হয়, তবে সর্বসাধারণের মুখোমুখি হওয়ার প্রয়োজন নেই। তাদেরকে নিজের মতো চলতে দিন। অর্থাৎ পরিস্থিতি যদি এমন হয় যে আপনি নিপীড়ন বা হত্যার সম্মুখীন হতে পারেন, তাহলে শুধু ব্যক্তিগত জীবনেই মুসলিম হিসেবে থাকুন। নবিজি (সা) প্রথম তিন বছর তা-ই করেছিলেন।
(২) দ্বন্দ্ব-সংঘাত পরিহার করে সর্বসাধারণের কাছে দাওয়াত:
মুখে মুখে শান্তিপূর্ণভাবে প্রচার। এমনকি আপনাকে হত্যা করা হলেও আপনি তার প্রতিশোধ নিতে পারবেন না। এটা ছিল নবিজির (সা) মক্কার প্রথম দশ বছরের দাওয়াত। এর মধ্যে শেষ ছয়-সাত বছর ছিল অত্যন্ত কঠিন। তখন তাঁদের একাধিকবার হত্যার চেষ্টা করা হলেও বিষয়টি এমন ছিল যে এই সময় ইসলাম গ্রহণকারী কাউকে মেরে ফেললেও হত্যাকারীদেরকে স্পর্শ করা যাবে না।
৩) একটি নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর সাথে লড়াই চালিয়েও মুখে মুখে দাওয়াত:
হিজরতের পরের প্রথম ছয় বছর এমন ঘটেছিল: মুসলিমরা শুধু মক্কার কুরাইশদের সঙ্গে যুদ্ধ করেছিলেন, অন্য কোনো উপজাতির সঙ্গে জড়াননি। কারণ, তাঁরা চাইছিলেন যেন অন্য কারও আক্রমণের শিকার হতে না হয় ।
৪) সম্মানের সঙ্গে সকলের কাছে সরাসরি ও উন্মুক্ত দাওয়াত:
এক্ষেত্রে আপনি রাজনৈতিকভাবে ক্ষমতাশালী হলেও শুধু প্রয়োজন হলেই আত্মরক্ষার জন্য প্রতি-আক্রমণ করবেন। সুযোগ থাকলেও সামরিক সক্ষমতার অপ্রয়োজনীয় ব্যবহার করবেন না। হুদাইবিয়ার সন্ধির পর থেকে মক্কা বিজয় পর্যন্ত মুসলিমরা মদিনায় এ রকম অবস্থায় ছিল। হুদায়বিয়ার সন্ধির অন্যতম শর্ত ছিল, কোনো যুদ্ধ হবে না। অতএব ক্ষমতা, সৈন্যবাহিনী ও সংস্থান থাকা সত্ত্বেও মসুলিমরা কোনো যুদ্ধ-বিগ্রহে লিপ্ত হননি।
রাজনৈতিক পরিস্থিতিও এমন ছিল না যে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়তে হবে। সে সময় স্থিতাবস্থা বজায় রাখাই ছিল সর্বোত্তম, মুসলিমরা ঠিক কাজটিই করেছেন। আল্লাহ তায়ালাও এটাকে অন্যতম বড়ো বিজয় হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছেন, “(হে নবি) নিশ্চয়ই আমি তোমার জন্য সুস্পষ্ট বিজয় দান করেছি।” [সুরা ফাতহ, ৪৮:১] উমর (রা) শুরুতে বিষয়টা বুঝতে না পেরে বলেছিলেন, “এ কেমন বিজয়?” কিন্তু এই আয়াত শোনার সঙ্গে সঙ্গে তিনি বিষয়টি ভালোভাবে অনুধাবন করতে পেরেছিলেন।

৫) ইসলামের বিরোধিতাকারীদের সঙ্গে সরাসরি সংঘাতের পাশাপাশি উন্মুক্ত দাওয়াত:
এই পর্যায়ে দাওয়াতের সময়ই নবি করিম (সা) ইন্তেকাল করেন। নবিজি (সা) জীবদ্দশায় রোমসহ বিভিন্ন স্থানে সেনাবাহিনী পাঠিয়েছিলেন। আর সাহাবিরা দাওয়াতের এই পঞ্চম ধাপ অব্যাহত রেখেছিলেন। তার ফলে মুসলিমরা খুব অল্প সময়ের মধ্যেই পারস্য ও রোমান সাম্রাজ্যের বেশিরভাগ অংশ দখল করেন। উপরন্ত তাঁরা দামেস্ক, ফিলিস্তিন, মিশর ও উত্তর আফ্রিকা দখল করেন। তারপর উমাইয়ারা উজবেকিস্তান, তাজিকিস্তান, আফগানিস্তান, পাকিস্তান, ভারতের কিছু অংশ হয়ে চীন পর্যন্ত চলে গিয়েছিলেন। অবশেষে আব্বাসীয় রাজত্বের মাঝামাঝি সময়ের তাঁরা দাওয়াতের চতুর্থ পর্যায়ে ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন।
আসলে মুসলিম উম্মাহর খলিফাদের যুগের অধিকাংশ সময়েই আমরা দাওয়াতের চতুর্থ পর্যায়ে ছিলাম। এ থেকে বোঝা যায়, সামরিক শক্তির প্রয়োগ ইসলামি পথের অংশ নয়, যদিও প্রয়োজনে কখনো কখনো তা প্রয়োগ করা হয়েছিল। মূল উদ্দেশ্য ছিল ইসলামের বার্তা বা দাওয়াত পৌঁছে দেওয়া।
ঐতিহাসিকভাবে বলতে গেলে, আমাদের উম্মাহ্ দাওয়াতের কাজে ওপরে উল্লেখিত সব পর্যায়ই ব্যবহার করেছে। উল্লিখিত আলোচনার প্রেক্ষিতে এ কথা সন্দেহাতীতভাবে বলা যায় যে বর্তমান সময়ে আমাদের উম্মাহর জন্য সামরিক শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে দাওয়াতের জন্য উপযুক্ত পরিস্থিতি বিরাজ করছে না। আমরা যারা সংখ্যালঘু হিসেবে বিভিন্ন দেশে বাস করছি এটা তাদের জন্য বিশেষভাবে প্রযোজ্য। এই সময়ে আমরা সর্বপ্রকার দ্বন্দ্ব-সংঘাত এড়িয়ে প্রকাশ্যে দাওয়াত প্রচার করব। যদি দেখি আমাদের মধ্যে কেউ বিরূপ ও হিংসাত্মক আচরণ করছে, তাহলে বলব, “না! আমাদের ধর্ম এটা সমর্থন করে না।” নবিজি (স) পরিষ্কারভাবে আমাদের করণীয় বলে দিয়েছেন। তাঁর দেখানো পদ্ধতিই সর্বোত্তম পদ্ধতি, তাঁর জীবনধারাই সর্বোত্তম জীবনধারা।
বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে বসবাসকারী মুসলিম, তাঁদের নেতা ও স্কলারদের পর্যালোচনা করে দেখতে হবে, দাওয়াতের এই পাঁচটি পর্যায়ের মধ্যে কোনটি তাদের সম্প্রদায়ের পক্ষে সবচেয়ে উপযোগী। এগুলোর প্রত্যেকটিই আমাদের নবিজির (সা) দেওয়া বিধান অনুসারে দাওয়াতের জন্য যুক্তিযুক্ত উপায় ।
আরো পড়ুনঃ
- জুবায়ের ইবনুল আওয়াম (রা) | দ্বিতীয়বারের ওহি | মহানবী হযরত মুহাম্মদ ( সাঃ ) জীবন
- আবদুর রহমান ইবনে আওফ (রা) | দ্বিতীয়বারের ওহি | মহানবী হযরত মুহাম্মদ ( সাঃ ) জীবন
- আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা) | দ্বিতীয়বারের ওহি | মহানবী হযরত মুহাম্মদ ( সাঃ ) জীবন
- ব্যক্তিগত পর্যায়ে ইসলামের দাওয়াত | মহানবী হযরত মুহাম্মদ ( সাঃ ) জীবন
- সাওয়াত ব্যক্তিগত পর্যায়ে রাখার অনেক কারণ ছিল | ব্যক্তিগত পর্যায়ে ইসলামের দাওয়াত | মহানবী হযরত মুহাম্মদ ( সাঃ ) জীবন