ধর্মীয় স্বাধীনতা নিয়ে কিছু প্রাসঙ্গিক বিষয় | চুক্তি ও মদিনার সংবিধান, ধর্মীয় স্বাধীনতার বিষয়টি ফিকহের বইগুলোতে অনেক বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা হয়েছে। উহাহরণস্বরূপ, যদি কোনো মুসলিম পুরুষ কোনো খ্রিষ্টান নারীকে বিয়ে করে, তবে কি সে তার স্ত্রীকে মদ পান করা থেকে বিরত রাখতে পারবে? অধিকাংশ পণ্ডিতের মত অনুসারে, বিরত রাখতে পারবে না। সে নিজের বাড়িতে মদ না রাখার সিদ্ধান্ত প্রয়োগ করতে পারবে, কিন্তু স্ত্রীকে মদ্যপান না করার জন্য চাপ দিতে পারবে না। কারণ মদ খ্রিষ্টানদের জন্য হালাল; এবং ক্যাথলিকরা গির্জার মধ্যে তাদের ধর্মীয় আচারের অংশ হিসেবে মদ্যপান করে। ইসলাম এতটাই ধর্মীয় স্বাধীনতার অনুমতি দেয়।
ধর্মীয় স্বাধীনতা নিয়ে কিছু প্রাসঙ্গিক বিষয় | চুক্তি ও মদিনার সংবিধান | মহানবী হযরত মুহাম্মদ ( সাঃ ) জীবন
দুঃখের বিষয়, বর্তমানকালে অভিযোগ করা হয় আমরা মুসলিমরা অসহিষ্ণু। কিন্তু আমরা যদি ওইসব অভিযোগকারীর অতীত ইতিহাসের সঙ্গে আমাদের তুলনা করি, তাহলে দেখতে পাব আমাদেরকে ধর্মীয়ভাবে তাদের ধৃষ্টতা ছাড়া কিছু নয়। যেখানে পশ্চিমারা মানবজাতির ধর্মীয় ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি অসহিষ্ণুতার নজির রেখেছে, সেখানে আমাদেরকে অসহিষ্ণু বলার কোনো অধিকার তাদের নেই কনস্ট্যান্টাইন খ্রিষ্টান ধর্ম গ্রহণ করার পর কী করেছিলেন? তিনি খ্রিষ্টধর্মে ট্রিনিটির ধারণা প্রবর্তন করতে গিয়ে এই ধর্মের অন্য সব ধারাকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন।
অন্যান্য ধারা বলতে আমরা তাঁদের বুঝব যারা বিশ্বাস করতেন যে যিশুই ছিলেন ‘মসিহ’ এবং তিনি ঈশ্বরের পুত্র নন। যাঁরা বিশ্বাস করতেন যে খ্রিষ্টধর্ম নতুন কোনো ধর্ম নয় (অর্থাৎ খ্রিষ্টধর্ম হচ্ছে ইহুদি ধর্মের সঙ্গে মসিহর প্রতি বিশ্বাস যোগ করা)। কনস্ট্যান্টাইন আসার পর ট্রিনিটির ধারণা যারা অনুসরণ করত না তাদের সবাইকে হয় দেশ ছেড়ে পালাতে হয়েছিল, নয়তো হত্যার শিকার হতে হয়েছিল।
কনস্ট্যান্টাইনের প্রধান প্রতিপক্ষ আরিয়াস ট্রিনিটি বা যিশুর ঐশ্বরিকতায় বিশ্বাস করতেন না। ফলে জীবন বাঁচাতে তাঁকে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যেতে হয়েছিল। পুরো মধ্যযুগ জুড়েই ক্যাথলিকরা কয়েক লাখ মানুষককে হত্যা করেছে। এখানে আমরা শুধু ইহুদিদেরকেই হত্যা করার কথা বলছি না, একই ধর্মাবলম্বী অন্য খ্রিষ্টানদের হত্যা করার কথাও বলছি। রোমান ক্যাথলিকরা মতের ভিন্নতা সহ্য করতে পারেনি। হুগেনোটস নামে একটি দল ছিল যাদের কয়েক হাজার অনুসারীকে হত্যা করা হয়েছিল। এ ছাড়া বিশ থেকে তিরিশ হাজার অ্যানাব্যাপ্টিস্টদেরকে” মেরে ফেলা হয়েছিল।
ক্যাথলিক ও প্রোটেস্ট্যান্টদের মধ্যে যুদ্ধ হয়েছিল। এমনকি মার্টিন লুথারকে রোমান ক্যাথলিকদের ভয়ে সুইজারল্যান্ডে পালিয়ে যেতে হয়েছিল। বিখ্যাত ব্রিটিশ দার্শনিক ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানী জন লক খ্রিষ্টানদের সামনে তুর্কি অটোম্যানদের দৃষ্টান্ত হিসেবে তুলে ধরে বলেছিলেন, “তুর্কিরা বিভিন্ন ধর্মমতের মানুষকে শান্তিপূর্ণভাবে বাস করতে দিচ্ছে। আপনারা কেন তাদের অনুসরণ করছেন না?”
৬) মদিনা সংবিধানে আমরা দেখতে পাই, নবিজি (সা) প্রত্যেক দল বা গোষ্ঠীকেই ইসলামের রাষ্ট্রকাঠামোর ভেতরে প্রায় পূর্ণ স্বাধীনতা দিয়েছেন। প্রতিটি দল নিজ নিজ বিষয়ে নিজেরাই সিদ্ধান্ত নেবে। নিজেদের মধ্যেকার ঝগড়া-বিবাদ, অন্যায়-অপরাধে নিষ্পত্তি থেকে শুরু করে ভালো-মন্দ সবকিছুর ব্যবস্থা নিজেরাই নেবে। কিন্তু কোনো বাহ্যিক আক্রমণ বা হুমকি এলে তারা তা ঐক্যবদ্ধভাবে মোকাবিলা করবে।
৭) আপনি মুসলিম বা অমুসলিম যা-ই হোন না কেন, অপরাধ করলে আপনার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। মুসলিম হলেই অপরাধ করে পার পেয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই। সংবিধানে বলা আছে, ধর্ম-নির্বিশেষে প্রত্যেক অপরাধীর বিরুদ্ধেই ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। যেমন, একজন হত্যাকারীকে কেউ আশ্রয় দিতে পারবে না। সেই সময়ের প্রেক্ষাপটে এ সবই ছিল আধুনিক ও সুদূরপ্রসারী চিন্ত ভাবনা।
৮) সংবিধান অনুসারে, শরিয়তের বিধিবিধানের পরিপন্থি না হলে প্রতিটি উপজাতি ও গোত্রের নিজস্ব আইন ও রীতিনীতি বহাল থাকবে। উল্লেখ্য, সংবিধানে ফিকহ বিষয়ে পাঁচটি প্রধান বিধি রয়েছে; তার একটি হলো: শরিয়তের কোনো বিধান না থাকলে, স্থানীয় জনগণের সংস্কৃতি ও রীতি-আচারকে অগ্রাধিকার দেওয়া হবে।
নবিজি (সা) মদিনায় আসার পরে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপগুলোর সারসংক্ষেপ
- নবি করিম (সা) মদিনায় আসার পর এইসব গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নিয়েছিলেন :
১) তিনি প্রথমেই একটি মসজিদ নির্মাণ করেন; কারণ মসজিদ তওহিদ ও ইসলামের মূল ভিত্তি।
২) তারপর তিনি মুহাজির ও আনসারদের মধ্যে মুয়াখার (জুটি বাঁধার) মাধ্যমে ভ্রাতৃত্বের বন্ধন প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেন ।
৩) তারপর একটি সংবিধানটি রচনা করেন যার মাধ্যমে তিনি বিভিন্ন ধর্মমতের (মুসলিম, ইহুদি ইত্যাদি) আলাদা আলাদা ধর্মীয় অবস্থানকে অনুমোদন দেন।