পবিত্র কোরানে হিজরত-বিষয়ক আয়াতসমূহ: নমনীয় থেকে কঠোর | মদিনা যুগের সূচনা | মহানবী হযরত মুহাম্মদ ( সাঃ ) জীবন

পবিত্র কোরানে হিজরত-বিষয়ক আয়াতসমূহ: নমনীয় থেকে কঠোর | মদিনা যুগের সূচনা, মদিনায় মুহাজিরদের সংখ্যা কত ছিল? দ্বিতীয় হিজরিতে সংঘটিত বদরের যুদ্ধে অংশগ্রহণকারীদের সংখ্যা থেকে আমরা একটি অনুমান করতে পারি। যুদ্ধে ৮২ জন পুরুষ মুহাজির অংশগ্রহণ করেন। সেই হিসেবে মদিনায় নারী ও শিশু মুহাজিরের সংখ্যা ছিল আনুমানিক ৩০০-৪০০। তবে সংখ্যায় না হলেও মর্যাদায় তাঁদের অবস্থান ছিল আনসারদের থেকে ওপরে। আল্লাহ যখনই কোরানে মুহাজির ও আনসারদের কথা উল্লেখ করেছেন, সর্বদাই তিনি মুহাজিরদের আনসারদের ওপরে স্থান দিয়েছেন। কোরানের আয়াতেও মুহাজিরদের কথা আগে আসে। উদাহরণস্বরূপ:

“মুহাজির ও আনসারদের মধ্যে যারা প্রথম (দিকে ইমান এনেছে) এবং পরে যারা একান্ত নিষ্ঠার সাথে তাঁদের ভালোভাবে অনুসরণ করেছে, আল্লাহ তাদের ওপর সন্তুষ্ট আর তারাও তাঁর প্রতি সন্তুষ্ট।” [সুরা তওবা, ৯:১০০] পবিত্র কোরানে হিজরত-বিষয়ক আয়াতসমূহ: নমনীয় থেকে কঠোর সেই সময় নারী ও শিশুসহ প্রত্যেক মুসলিমের জন্য মদিনায় হিজরত করা ছিল বাধ্যতামূলক। নবি করিম (সা) ছিলেন সর্বশেষ হিজরতকারীদের মধ্যে একজন। প্রথমদিকে যারা হিজরত করেন তাঁদের অনেকেই নবিজির (সা) কাছে নিজেদের সম্পদ গচ্ছিত রেখেছিলেন। আলিকে (রা) দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল সেইসব সম্পদ বা ‘আমানত’ সংশ্লিষ্ট মালিকদের কাছে ফিরিয়ে দেওয়ার।

 

পবিত্র কোরানে হিজরত-বিষয়ক আয়াতসমূহ: নমনীয় থেকে কঠোর | মদিনা যুগের সূচনা | মহানবী হযরত মুহাম্মদ ( সাঃ ) জীবন

 

পবিত্র কোরানে হিজরত-বিষয়ক আয়াতসমূহ: নমনীয় থেকে কঠোর | মদিনা যুগের সূচনা | মহানবী হযরত মুহাম্মদ ( সাঃ ) জীবন

আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা পবিত্র কোরানে মদিনায় হিজরতের নির্দেশমূলক অনেক আয়াত নাজিল করেন। মুসলিমদের হিজরত করার জন্য প্রতিটি আয়াতে আগের আয়াতের চেয়ে কঠোরভাবে নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। আল্লাহ প্রথমে হিজরত করতে উৎসাহিত করেছেন এবং শেষের দিকে একপর্যায়ে হুমকি প্রদান করেছেন। যেমন, সুরা হজে আল্লাহ বলেছেন: “যারা আল্লাহর পথে হিজরত করেছে এবং পরে (আল্লাহর পথে) নিহত হয়েছে বা মৃত্যুবরণ করেছে, আল্লাহ তাদের জন্য (পরলোকে) উৎকৃষ্ট রিজিক (জীবনের উপকরণ) দান করবেন। আর আল্লাহই সর্বোৎকৃষ্ট রিজিকদাতা।”

এখানে উৎসাহ দেওয়া হয়েছে, কিন্তু কোনো হুমকি দেওয়া হয়নি। এর দুই-তিন বছর পরে আল্লাহ সুরা নিসায় বলছেন: “যারা নিজেদের ওপর জুলুম (অত্যাচার) করে, তাদের প্রাণ নেওয়ার সময় ফেরেশতারা বলে, ‘তোমরা কী অবস্থায় ছিলে?’ তারা বলে, দুনিয়ায় আমরা অসহায় ছিলাম।’ তারা (ফেরেশতারা) বলে, ‘তোমরা নিজের দেশ ছেড়ে অন্য দেশে বসবাস তো করতে পারতে, (তোমাদের জন্য) আল্লাহর এ দুনিয়া কি প্রশস্ত ছিল না?’ এরাই বাস করবে জাহান্নামে, আর তা খুবই নিকৃষ্ট বাসস্থান।”

[৪:৯৭] ভাগীদার অর্থাৎ ‘তোমরা যদি হিজরত না করো, তবে তোমরা বড় পাপের হবে, আর আল্লাহ তোমাদেরকে শাস্তি দেবেন।’  লক্ষ করুন, এটিই আল্লাহর ‘সুন্নাহ’ বা পদ্ধতি। আল্লাহ ধীরে ধীরে আইন প্রবর্তন করেন; প্রথমে উৎসাহমূলকভাবে করতে বলেন, তারপরে এক সময়ে তা বাধ্যতামূলক করেন।

মক্কায় অবস্থানরত মুসলিমদের দুটি দল ছিল: (১) যারা নবিজি (সা) মদিনায় হিজরত করার আগেই ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন, কিন্তু নিজেরা হিজরত করেননি (তাঁদের নামধাম আমাদের জানা নেই); এবং (২) যাঁরা নবিজি (সা) মদিনায় হিজরত করার পরে মক্কায় ধর্মান্তরিত হয়েছিলেন (এরকম কয়েকজনের নাম জানা যায়)। উল্লেখ্য, নবিজি (সা) মদিনায় হিজরত করার পরেও মক্কায় দাওয়াত অব্যাহত ছিল। তবে এই উভয় দলের ওপরই হিজরত বাধ্যতামূলক ছিল।

ইবনে আব্বাস বলেছেন, “একদল মুসলিম মক্কায় থেকে গিয়েছিল। যেহেতু তারা তাদের ইসলাম গ্রহণের ব্যাপারটি অন্যদের কাছে প্রকাশ করেনি (অত্যাচারের ভয়ে), সেহেতু বদরের যুদ্ধে তারা ভুল (কুরাইশ) দলের পক্ষে অংশ নিতে বাধ্য হয়েছিল।” তারা সত্যিকার অর্থে যুদ্ধ করেনি, কেবল পেছনে পেছনে থেকেছিল। তবে তাদের মধ্যে কেউ কেউ মুসলিম পক্ষের তিরের আঘাতে মারা গিয়েছিল।

আল্লাহ তায়ালা সেইসব লোককে উদ্দেশ করে উপরোক্ত আয়াতটি [৪:৯৭] নাজিল করেন। ফেরেশতারা তাদের জিজ্ঞেস করবে, “তুমি এখানে কী করছ তুমি কোন দলের? কীভাবে তুমি মুসলিমদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে পার?” উত্তরে তারা বলবে, “আমরা দুর্বল ছিলাম, যুদ্ধ করতে বাধ্য হয়েছি।” তখন ফেরেশতারা বলবে, “তোমাকে তো মক্কায় থাকতে বাধ্য করা হয়নি। তুমি অন্য কোনো জায়গায় (অর্থাৎ মদিনায়) চলে যেতে পারতে।” ইবনে আব্বাস বলেন, “আল্লাহ তাদের বলেছিলেন, তাদের হিজরত না করার পক্ষে কোনো অজুহাত নেই । সুরা নিসার এই আয়াতটি তাদের উদ্দেশ করেই নাজিল করা হয়েছে।”

এ থেকে ধারণা করা যায়, মক্কার মুসলিমদের সঙ্গে নবিজির (সা) গোপন যোগাযোগ অব্যাহত ছিল। নবিজি (সা) নিশ্চিতভাবেই জানতেন কারা মুসলিম, কারণ তাঁরাই তাঁকে তা জানিয়েছিলেন। সুতরাং তিনি মক্কার মুসলিমদের কাছে কিছু বার্তা পাঠিয়েছিলেন যার মধ্যে কোরানের এই আয়াতটিও ছিল। ইবনে আব্বাসের বর্ণনা অনুসারে, তাদের মধ্যে কেউ কেউ হিজরত করার চেষ্টা করেছিলেন, তবে পৌত্তলিকরা তাঁদের বাধা দেয়। তাই তাঁরা মক্কায় থেকে যান।

 

islamiagoln.com google news
আমাদের গুগল নিউজে ফলো করুন

 

এ বিষয়ে আল্লাহ সুরা আনকাবুতের একটি আয়াত নাজিল করেন: “মানুষের মধ্যে কিছু লোক যারা (মুখে) বলে, ‘আমরা আল্লাহর ওপর ইমান এনেছি’, কিন্তু যখন তাদের আল্লাহর পথে (চলার কারণে) কষ্ট দেওয়া হয় তখন তারা মানুষের দেওয়া এ অত্যাচারকে আল্লাহর শাস্তির মতোই গণ্য করে, আবার যখন তোমার প্রতিপালকের কাছ থেকে কোনো সাহায্য আসে তখন তারা (মুসলমানদের) বলতে থাকে, অবশ্যই আমরা তোমাদের সাথে ছিলাম।” [২৯:১০] অর্থাৎ তাঁরা মুসলিম হতে চান, আবার মক্কায় থেকে যেতেও চান।

কেন তাঁরা মক্কায় থাকতে চান? কারণ তাঁদের সব সম্পদ মক্কায় নিজেদের হেফাজতে ছিল। আমরা যেমন এখন ব্যাংকের মাধ্যমে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে সহজেই টাকা পাঠাতে পারি, তখন এভাবে অর্থ স্থানান্তর করা সম্ভব ছিল না। তার মানে, হিজরত করলে তাদের সব অর্থকড়ি নিজের দেশে (অর্থাৎ মক্কায়) রেখে যেতে হবে। অন্য অর্থে, হিজরত মানেই জেনেশুনে নিশ্চিত দারিদ্র্য বরণ করে নেওয়া। জাগতিক এই বিষয়টিই এখানে মুখ্য ছিল। সুতরাং এই স্বল্প সংখ্যক (সম্ভবত ৩-৫ জন) মানুষ মদিনায় হিজরত করার চেয়ে ধনসম্পদের মোহে মক্কায় বসবাস করাকেই বেছে নেন।

তারপর একই আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, “(এরা কি মনে করে) আল্লাহ কি মানুষের অন্তরের গোপন বিষয় সম্পর্কে মোটেই অবগত নন?” [২৯ঃ১০] অর্থাৎ আল্লাহ মুমিনদের অন্তরে যা আছে তা অবশ্যই জানেন । এখন আমরা একজন সাহাবির কাহিনি উল্লেখ করব, যিনি নবিজি (সা) মদিনায় হিজরত করার পরে ইসলাম গ্রহণ করেন। তাঁর নাম ছিল জুনদা ইবনে দামুরা ইবনে আব্বাস বর্ণনা করেছেন, যখন ফেরেশতারা তাদের জিজ্ঞেস করবে, ‘তোমরা কী করছিলে?’ তারা বলবে, ‘আমরা তো দুর্বল ছিলাম।’

[সুরা নিসা, ৪:৯৭] আমরা দেখছি, আল্লাহ তাদের এই অজুহাত গ্রহণ করেননি। তবে নবি করিম (সা) একটি ক্ষেত্রে ব্যতিক্রমকে মেনে নেন: যারা সত্যিই খুব দুর্বল তাদের তিনি ক্ষমা করেন। জুননা নামের এই সাহাবি ছিলেন সেরকমই এক ব্যতিক্রম। জুনদা ইবনে দামুরা ছিলেন বৃদ্ধ ও অস্ত্র। তিনি এতটাই দুর্বল ছিলেন যে তিনি নিজে নিজে হাঁটতেও পারতেন না। কিন্তু এই আয়াতটি নাজিল হওয়ার পর তিনি বললেন, “কোনো অজুহাত দাঁড় করানো ব্যক্তিদের মধ্যে আমি থাকতে চাই না। মদিনায় হিজরত করার সক্ষমতা আমার আছে। আমি আর একটি রাতও মক্কায় কাটাতে চাই না।” অতএব তিনি তাঁর পরিচারকদের বললেন, তারা যেন তাঁকে চেয়ারে বসিয়ে শহরের বাইরের প্রান্ত পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে আসে। মদিনা পর্যন্ত পৌঁছানোর ব্যাপারে তাঁর ‘তাওয়াক্কুল’ (আল্লাহর ওপর ভরসা) ছিল।

মহান আল্লাহ তায়ালা ছিলেন তাঁর প্রতি অত্যন্ত সদয়। মক্কার বাইরে কিছুটা পথ যেতে না যেতেই তিনি মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুর ঠিক আগ-মুহূর্তে তিনি ডান হাতটি বাম হাতের উপরে রেখে বলেন, “হে আল্লাহ! নবিজি (সা) আমাকে যা করতে বলেছেন সে বিষয়ে এটিই তাঁর প্রতি আমার আনুগত্যের শপথ।” অর্থাৎ, ‘আমি সশরীরে তাঁর কাছে পৌঁছার সুযোগ পেলাম না। তবু আমি যতটুকু করতে পেরেছি, হে আল্লাহ, আপনি তা গ্রহণ করুন।’ তানিম এলাকা পর্যন্ত পৌঁছার পর তিনি মারা যান। তানিম এলাকাটি বর্তমানের আয়েশা মসজিদের কাছে অবস্থিত।

জুনদার মৃত্যুর খবর মদিনায় পৌঁছলে সাহাবিরা বললেন, “তাঁর কী দুর্ভাগ্য! তিনি প্রায় পৌঁছেই গিয়েছিলেন।” অর্থাৎ ‘তিনি অনেক চেষ্টা করেও শেষ পর্যন্ত পারলেন না। লক্ষ করুন, সাহাবিরা হিজরতের বিধান পালনের বিষয়ে কত কঠোর ও আন্তরিক ছিলেন। তারপরই আল্লাহ সুরা নিসার পরবর্তী দুটি আয়াত নাজিল করেন। “তবে যেসব অসহায় পুরুষ, নারী ও শিশু কোনো উপায় অবলম্বন করতে পারে না এবং কোনো পথও পায় না, আল্লাহ হয়তো তাদের পাপ ক্ষমা করবেন, কারণ আল্লাহ পাপমোচনকারী, ক্ষমাশীল।”

[৪:৯৮-৯৯ ] এই আয়াতে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা ‘হয়তো’ (বা ‘সম্ভবত’) শব্দটি ব্যবহার করেছেন। এ বিষয়ে ইবনে আব্বাস ব্যাখ্যা করেছেন, যখনই আল্লাহ কোনো বিষয়ে ‘হয়তো’ (বা ‘সম্ভবত’) বলেন, তখন আমাদের বুঝতে হবে যে তা নিশ্চিত।  অর্থাৎ আল্লাহ তায়ালা তাঁকে ক্ষমা করবেন। তবু মক্কায় থেকে যাওয়ার বিষয়ে যাদের সত্যিকারের কোনো কারণ নেই, তাদের স্খলনের গুরুত্ব বোঝানোর জন্য ‘হয়তো’ বা ‘সম্ভবত’ ব্যবহার করা হয়েছে।

 

পবিত্র কোরানে হিজরত-বিষয়ক আয়াতসমূহ: নমনীয় থেকে কঠোর | মদিনা যুগের সূচনা | মহানবী হযরত মুহাম্মদ ( সাঃ ) জীবন

 

আনুষঙ্গিক বিষয়: আমাদের সময়ের মুসলিমরা কি মুসলিম-সংখ্যালঘু দেশে বসবাস করতে পারে?

হিজরতের সঙ্গে ‘দারুল কুফর” ও “দারুল ইসলামে” বাস করার বিষয়টি আমাদের সময়ের জন্য অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। এটা ভালোভাবে বুঝতে হলে দীর্ঘ ফিকহ আলোচনা প্রয়োজন। তবে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো পর্যালোচনা করে একথা বলা যায়, মক্কা থেকে মদিনায় হিজরতের বিষয়টি তৎকালীন মুসলিমদের জন্য ছিল ‘ফরজে আইন’ (বাধ্যতামূলক)।

হিজরতের পঞ্চম বছরে আহজাবের যুদ্ধের পরে মুসলিমদের শক্তিমত্তা স্পষ্ট হয়ে যায়। তখন থেকে হিজরতের বাধ্যবাধকতা শিথিল করা হয়; আর মক্কাবিজয়ের পরে তা পুরোপুরি বাতিল করা হয়। সহিহ বুখারিতে বর্ণিত আছে, নবিজি (সা) বলেছেন, “মক্কাবিজয়ের পরে আর কোনো হিজরত নেই।” অর্থাৎ তখন থেকে মক্কা থেকে মদিনায় হিজরত করার নির্দেশ আর বলবৎ ছিল না। ওই পর যদি কোনো মুসলিম হিজরত করেন, তবে তিনি হিজরতের জন্য আল্লাহর প্রতিশ্রুত প্রতিদান পাবেন না।

মদিনায় হিজরতের আদেশ বাতিলের বিষয়টিকে কেন্দ্র করে পরবর্তীকালে ইসলামের চার মাজহাবের মধ্যে ফিকহ বিতর্কের সৃষ্টি হয়। এখানে প্রশ্ন উঠতে পারে, মুসলিমদের জন্য কি অমুসলিম দেশে বসবাস করা অনুমোদিত? মধ্যযুগে যখন ইসলামি রাষ্ট্রের অস্তিত্ব ছিল, তখন এ বিষয়ে পণ্ডিতদের দুটি মতামত ছিল:

১) বেশিরভাগ হানাফি, হানবালি ও শাফেরি ফিকহশাস্ত্রবিদের মতে, একজন মুসলিম ‘দারুল ইসলাম’ নয় এমন রাষ্ট্রে বাস করতে পারেন যদি তিনি সেখানে ইসলামি জীবনযাপন করতে পারেন। অর্থাৎ তাঁকে নামাজ পড়তে বাধা দেওয়া হবে না, হারাম কাজ করতে বাধ্য করা হবে না, সেখানে হালাল খাবারের ব্যবস্থা আছে, ইত্যাদি ।

একটি সহিহ হাদিস থেকে জানা যায়, নবিজির (সা) জীবনের শেষের দিকে ফুলায়েক নামের এক সাহাবি মদিনায় আসেন। তিনি নবিজিকে (সা) জিজ্ঞেস করেন, “হে আল্লাহর রসুল! লোকেরা বলাবলি করছে যে যিনি হিজরত করবেন না তিনি ধ্বংসপ্রাপ্ত হবেন।” আরেকটি ভাষ্য অনুসারে তিনি বলেছিলেন, “আমার সম্প্রদায় শিরক করছে, তাই লোকেরা আমাকে হিজরত করতে বলছে।” তাঁর দেশে (বা এলাকায়) সেই সময় মুসলিমদের শাসন ছিল না। সেখানকার লোকেরা ছিল মুশরিক। নবিজি (সা) বললেন, “হে ফুদায়েক! নামাজ কায়েম করো, গুনাহ এড়িয়ে চলো এবং তোমার লোকদের সঙ্গে যেখানে খুশি সেখানে বাস করো।”

এই হাদিসটি ইবনে হিব্বানের সহিহতে বর্ণিত আছে। হাদিসটিতে অমুসলিম শাসনের অধীনে বসবাসের ব্যাপারে সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা রয়েছে। ফুদায়েককে কিছু লোক বলেছিল যে, যারা শিরক করছে তাদের সঙ্গে একই এলাকায় বসবাস করা ইসলামের দৃষ্টিতে বৈধ নয়। কিন্তু এই হাদিস অনুসারে আমরা দেখি, নবিজি (সা) তাঁকে তাঁর লোকদের সঙ্গে থাকার অনুমতি দিয়েছেন।

(২) মালিকি মাজহাব এ বিষয়ে অনেকটাই কঠোর অবস্থান নিয়েছে। এই মাজহাবের মতে, যদি দারুল ইসলাম থাকে তাহলে কোনো মুসলিমের জন্য দারুল কুফরে বসবাস অনুমোদিত নয়। এ বিষয়ে তাদের এমন কঠোরতার কারণ আন্দালুসের ঘটনা। আন্দালুসে মালিকি মাজহাব প্রতিষ্ঠিত ছিল। সেখানে মুসলিমনের ক্ষেত্রে যা ঘটেছিল তা অত্যন্ত দুঃখজনক: তাঁদের শূকরের মাংস খেতে এবং ইসলামবিরোধী পোশাক পরতে বাধ্য করা হয়েছিল। প্রথমদিকে

বিজয়ী ফার্দিনান্দ ও ইসাবেলা নিশ্চয়তা দিয়েছিল যে মুসলিমরা নিরাপদে বসবাস করতে পারবে। কিন্তু পরবর্তীকালে মুসলিমদেরকে নির্মম অত্যাচারের জর্জরিত করা হয়েছে। এসব দেখে সেখানকার মালিকি পণ্ডিতদের মধ্যে মুসলিমদের জন্য দারুল কুফরে বসবাসের ক্ষেত্রে দৃষ্টিভঙ্গি বদলে যায়। তাঁদের মনে হয়েছিল যে, দারুল কুফরে থাকলে এরকম ঘটে থাকে। এ কারণেই মালিকি মাজহাব ছিল এই বিষয়ে অত্যন্ত কঠোর।

এখন প্রশ্ন হলো, ৫০০ বছর আগে যখন পৃথিবীতে দারুল ইসলাম ও খেলাফত ছিল, সেই সময়ের ফতোয়া কি আমাদের এই সময়ে প্রযোজ্য? এখন তো শুধু ভারতেই দুইশ মিলিয়ন মুসলিম রয়েছেন; তাঁদের আপনি কোথায় পাঠাবেন? হিসাব করে দেখুন, পৃথিবীর অর্ধ বিলিয়ন মুসলিমই সংখ্যালঘু হিসেবে বিভিন্ন দেশে বাস করছেন। আমাদের সময়ে অনেক পণ্ডিত বলেন, হিজরত করা ওয়াজিব (বাধ্যতামূলক)। যথাযোগ্য সম্মানের সাথেই বলতে হয় যে, তাঁরা মোটেই বাস্তববাদী নন।

মনকি নবিজির (সা) সময়েও হিজরত ওয়াজিব ছিল শুধু মক্কা ও মদিনার বিশেষ পরিস্থিতির কারণে। সুতরাং আমরা বলতে পারি: যদি কোনো দেশ ইসলামি জীবনযাপনের জন্য কঠিন হয়ে পড়ে, শুধু তাহলেই হিজরত ওয়াজিব হবে। আর এই বিবেচনার ভার ছেড়ে দিতে হবে সংশ্লিষ্ট দেশের আলেমদের ওপর। আমেরিকা, ইংল্যান্ড প্রভৃতি দেশে ইসলামি জীবনযাপনের সম্পূর্ণ স্বাধীনতা রয়েছে। তাই এখান থেকে হিজরত করার কোনো প্রয়োজন নেই।

আরও পড়ূনঃ

Leave a Comment