মুদ্রাখা ও আনসারদের উদারতা | সুফ্ফার লোকেরা | মহানবী হযরত মুহাম্মদ ( সাঃ ) জীবন

মুদ্রাখা ও আনসারদের উদারতা | সুফ্ফার লোকেরা, নবিজি (সা) মদিনায় শুরুতেই মুহাজির ও আনসারদের মধ্যে ‘মুয়াখা’ বা ভ্রাতৃত্বের বন্ধনের প্রতিষ্ঠা করার উদ্যোগ নেন। তিনি চেয়েছিলেন মুহাজির ও আনসাররা যেন পরস্পরের ভাইয়ের মতো সহাবস্থান করেন। তিনি আনসারদেরকে মুহাজিরদের প্রতি উদার হতে উৎসাহিত করেন। সত্যিই তাঁরা (আনসাররা) উদারতার স্বাক্ষর রেখেছিলেন।

 

মুদ্রাখা ও আনসারদের উদারতা | সুফ্ফার লোকেরা | মহানবী হযরত মুহাম্মদ ( সাঃ ) জীবন

 

মুদ্রাখা ও আনসারদের উদারতা | সুফ্ফার লোকেরা | মহানবী হযরত মুহাম্মদ ( সাঃ ) জীবন

আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা পবিত্র কোরানে আনসারদের উদারতার কথা উল্লেখ করেছেন: “মুহাজিরদের আসার আগে এই শহরটির যেসব আধিবাসী ইমান এনেছিল, তারা মুহাজিরদের ভালোবাসে এবং মুহাজিরদের যা দেওয়া হয়েছে তার জন্য তারা (তাদের) মনে মনে ঈর্ষা করে না, নিজেরা অভাবগ্রস্ত হলেও তারা মুহাজিরদেরকে নিজেদের ওপরে জায়গা দেয়।” [সুরা হাশর, ৫৯:৯] উল্লেখ্য, আল্লাহ উপরোক্ত আয়াতে মদিনা শহরকে ‘আল-দার’ (আবাসটি, একটি নির্দিষ্ট আবাস) বলে উল্লেখ করেছেন।

ক্ষণীয়, আল্লাহ তায়ালা এখানে “তাঁদের আবাস’ না বলে ‘আবাসটি’ বলেছেন। এই দুয়ের মধ্যে পার্থক্য কী? এটা তো আনসারদেরই আবাস ছিল। আল্লাহ একে ‘আবাসটি’ বলেছেন; কারণ আনসাররা তাঁদের আবাসের অর্ধেক অংশ মুহাজিরদেরকে দিয়ে দিয়েছিলেন। সুতরাং আল্লাহ মদিনাকে বলেছেন আনসার ও মুহাজিরদের আবাস। আনসাররা মুহাজিরদেকে বাড়িঘর, খাবার, প্রাণী ইত্যাদি প্রয়োজনীয় সবই নিয়েছিলেন; উপরোক্ত আয়াতে [৫৯:৯] আল্লাহ সেই স্বীকৃতিই দিয়েছেন।

সহিহ বুখারিতেও বর্ণিত আছে, কিছু সংখ্যক আন’সার একদিন নবিজির (সা) কাছে এসে বলেন, “হে আল্লাহর রসুল! আমরা আমাদের অর্ধেক ভূসম্পত্তি মুহাজিরদেরকে দিয়ে দিতে চাই।” নবিজি (সা) একথা শুনে তাঁদের জন্য দোয়া করেন। কিন্তু তিনি কোনো প্রতিদান ছাড়া এ জাতীয় উপহার গ্রহণ করার ব্যাপারে অস্বীকৃতি জানান। তিনি বলেন, ”তাঁরা জমিতে কায়িক শ্রম দেবে, আর তোমরা তাঁদের ফসলের ভাগ দেবে।”

এই ঘটনায় আমরা ইসলামের দৃষ্টিতে গুরুত্বপূর্ণ একটি মূল্যবোধের প্রকাশ দেখতে পাই। নবিজি (সা) চাননি মুহাজিররা বিনামূল্যে সবকিছু পেয়ে থাক। তিনি চেয়েছিলেন তারা পরিশ্রম করে উপার্জন করে নিক।  নবিজি (সা) এক্ষেত্রে সুদূরপ্রসারী চিন্তাভাবনা করেছিলেন। তিনি চাননি, শয়তান মুসলিমদের মধ্যে কয়েক প্রজন্মের ব্যবধানে কোনোরূপ শত্রুতা সৃষ্টি করুক। আন’সারদের বংশধররা পরবর্তীকালে মুহাজিরদের বলতে পারে, “ওহ, আমরা তোমাদেরকে সবকিছু নিখরচায় দিয়ে দিয়েছি।” আন’সারদের হৃদয় না হয় পবিত্র ছিল, কিন্তু ভবিষ্যতে তাঁদের বংশধররা কী করবে তা তো জানা সম্ভব। ছিল না। আবার মুনাকেরাও এরকম কথা বলতে পারত। সুতরাং নবিজি (সা) বিষয়টি দীর্ঘমেয়াদে চিন্তা করে সেরকম কিছু ঘটার সম্ভাবনা আগেভাগেই নির্মূল করেন। তিনি যেমন মুহাজিরদেরকে কাজ করার তাগিদ দিয়েছিলেন, তেমনি আন’সারদেরও উদার হওয়ার আহ্বান জানিয়েছিলেন।

 

islamiagoln.com google news
আমাদের গুগল নিউজে ফলো করুন

 

নবিজি (সা) প্রতিটি পুরুষ মুহাজিরকে একজন আন’সারের সঙ্গে জুটি বেঁধে দিয়েছিলেন। বর্ণিত আছে, প্রত্যেক পুরুষ মুহাজিরের একটি জুটি হিসেবে ১০০টির মতো জুটি সৃষ্টি করা হয়েছিল। প্রাথমিক পর্যায়ে জুটিগুলোর বন্ধন এতই মজবুত ছিল যে উত্তরাধিকারের ক্ষেত্রেও তাঁদের আপন ভাইয়ের মতো বিবেচনা করা হতো। উত্তরাধিকারের এই বিধানটি পরবর্তীকালে বাতিল করা হয়।

আপনি যদি মুয়াখার মাধ্যমে জুটিবদ্ধ ব্যক্তিদের লক্ষ করেন, তাহলে তাঁদের মধ্যে অনেক মিল দেখতে পাবেন। নবিজি (সা) খুব ভালো করেই জানতেন, তিনি কার সঙ্গে কার জুটি বেঁধে দিচ্ছেন। উদাহরণ হিসেবে আবু বকর (রা) ও খারিজাহ ইবনে জায়েদের মধ্যে মুয়াখার কথা উল্লেখ করা যায়। তাঁরা উভয়েই ছিলেন নিজ নিজ সম্প্রদায়ের অন্যতম অভিজাত ব্যক্তি। বিষয়টি সংশ্লিষ্ট সবাই বেশ গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছিলেন। তাঁরা আক্ষরিক অর্থেই একে অপরের ভাইয়ের মতো হয়ে উঠেছিলেন। এ বিষয়ে আবদুর রহমান ইবনে আওফ (মুহাজির) এবং সাদ ইবনে রাবিয়াকে (আন’সার) নিয়েও একটি বিখ্যাত গল্প রয়েছে।

সাদ ইবনে রাবিয়া তাঁর বাড়ি, অর্থকড়ি, জমিজমা ইত্যাদি সবকিছু আবদুর রহমান ইবনে আওফের সঙ্গে ভাগ করতে চেয়েছিলেন। এমনকি তিনি তাঁর দুই স্ত্রীর মধ্যে একজনকেও দিয়ে দেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। আবদুর রহমান বলেছিলেন, “আল্লাহ আপনাকে আপনার সম্পন্ন ও আপনার পরিবারে আরও বেশি। বরকত দান করুন। তবে আমি এর কোনো কিছুই চাই না। আমাকে আপনি শুধু একটা বাজারের হদিস দিন।” আবদুর রহমান বাজারে জিনিসপত্র কেনাবেচা করতে শুরু করেন।

তিনি কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে একপর্যায়ে আর্থিক প্রতিষ্ঠা লাভ করেন। সাদ ইবনে রাবিয়া ও আবদুর রহমান ইবনে আওফের ঘটনায় আনসাদের উদারতা ও মুহাজিরদের আত্মমর্যাদা লক্ষ করুন। একজন ইমানের কারণে দিতে চাচ্ছেন, অন্যজন ইমানের কারণেই তা নিতে চাচ্ছেন না। একদিন নবিজি (সা) দেখতে পেলেন, আবদুর রহমান সুগন্ধিযুক্ত সুন্দর পোশাক পরে হেঁটে যাচ্ছেন। আবদুর রহমান নবিজিকে (সা) জানালেন যে তিনি আন’সারদের এক নারীর সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়েছেন।

 

মুদ্রাখা ও আনসারদের উদারতা | সুফ্ফার লোকেরা | মহানবী হযরত মুহাম্মদ ( সাঃ ) জীবন

 

আন’সাররা মুহাজিরদের সাহায্যে এতটাই এগিয়ে এসেছিলেন যে, মুহাজিররা চিন্তিত হয়ে নবিজির (সা) কাছে গিয়ে বললেন, “হে আল্লাহর রসুল! আমরা এরকম মানুষ কখনও দেখিনি। তাঁরা সবসময় ভালো-মন্দ সবকিছুই আমাদের সঙ্গে ভাগ করে নিচ্ছেন, আমাদের উদার আচরণ করছেন, আমাদের প্রয়োজনীয় যত্ন নিচ্ছেন। তাঁদের এত কিছু করা দেখে আমরা চিন্তিত হয়ে পড়েছি এবং আশঙ্কা করছি যে তাঁরা যেন (বিচারের দিনে আল্লাহর কাছ থেকে) আমাদের প্রাপ্য প্রতিদান/পুরস্কার না নিয়ে নেন।” আসলে মুহাজিররা দুশ্চিন্তায় পড়ে গিয়েছিলেন এই ভেবে যে, মক্কায় অত্যাচার সহ্য করা, আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য সব সম্পদ পেছনে ফেলে রেখে আসা ইত্যাদির জন্য তাঁদের কাঙ্ক্ষিত পুরস্কার না আবার আন’সাররা নিয়ে নেয়।

অভিযোগের ধরনটি দেখুন। এটা কিন্তু আন’সারদের বিরুদ্ধে অভিযোগ নয়, স্পষ্টতই তাঁদের নিজস্ব ভালো কাজ সম্পর্কে উদ্বেগ। জবাবে নবিজি (সা) মুহাজিরদের বলেন, “না। তোমাদের পুরস্কার তাঁরা পাবেন না যতক্ষণ পর্যন্ত তোমরা তাঁদের প্রশংসা কর এবং তাঁদের জন্য দোয়া কর। তোমাদের পুরস্কার তোমাদের জন্য, তাঁদের পুরস্কার তাঁদের জন্য।” অর্থাৎ মুহাজিররা যা অর্জন করেছেন তা তাঁদেরই থাকবে। আনসাররা এত কিছু করার পরেও মুহাজিরদের মর্যাদা আনসারদের থেকে উঁচুতে।

বদরের যুদ্ধের পরে (২য় হিজরিতে) আল্লাহ এ বিষয়ে নিচের আয়াতটি নাজিল করেন: “আর যারা পরে ইমান এনেছে, হিজরত করেছে এবং তোমাদের সঙ্গে থেকে জেহাদ করেছে তারাও তোমাদের অন্তর্ভুক্ত। আর আল্লাহর বিধানে আত্মীয়রা ভএকে অন্যের চেয়ে বেশি হকদার। আল্লাহ সব বিষয়ই ভালো করে জানেন। [ সুরা আনফাল, ৮:৭৫] এই আঘাতের মাধ্যমে মুদ্রাখার ক্ষেত্রে উত্তরাধিকারের বিধানটি বাতিল করা হয়।

আরও পড়ূনঃ

Leave a Comment