ইয়াসরিনের একটি ছোট উপজাতি: খাজরাজ | ইয়াসরিবের জন্য বীজ রোপণ | মহানবী হযরত মুহাম্মদ ( সাঃ ) জীবন

ইয়াসরিনের একটি ছোট উপজাতি: খাজরাজ | ইয়াসরিবের জন্য বীজ রোপণ, আমরা জানি, নবিজির (সা) পিতার মাতামহী ছিলেন একজন ইয়াসরিবি। নবিজি (সা) একবার বা দুবার ইয়াসরিবে সফরও করেছিলেন। তবুও খাজরাজ নামে সেখানকার ছোট্ট জনগোষ্ঠীটি সম্পর্কে তাঁর খুব একটা জানা ছিল না। ইয়াসরিব শহরটিতে তিনটি প্রধান জনগোষ্ঠীর বাস ছিল; দুটি ছিল আরব, তৃতীয়টি ছিল তিনটি ইহুদি উপজাতির সমন্বয়ে একটি বড় গোষ্ঠী। আরব দুটি উপজাতির নাম ছিল আউস ও খাজরাজ। আর ইহুদি উপজাতিরা ছিল। বনু নাদির, বনু কায়নুকা ও বনু কুরায়জা।

 

ইয়াসরিনের একটি ছোট উপজাতি: খাজরাজ | ইয়াসরিবের জন্য বীজ রোপণ | মহানবী হযরত মুহাম্মদ ( সাঃ ) জীবন

 

ইয়াসরিনের একটি ছোট উপজাতি: খাজরাজ | ইয়াসরিবের জন্য বীজ রোপণ | মহানবী হযরত মুহাম্মদ ( সাঃ ) জীবন

শহরটি ছিল একটি সমৃদ্ধ মরূদ্যান, যার গোড়াপত্তন হয়েছিল তখন থেকে আনুমানিক ১০০ বছর আগে। তুলনামূলকভাবে নতুন শহর, যার কোনো প্রাচীন ঐতিহ্য ছিল না। সমগ্র হেজাজ অঞ্চলে শুধু ইয়াসরিব ও খায়বারেই ইহুদিদের বসবাস ছিল। এর বাইরে ইহুদিদের নিকটতম বসবাস ছিল ইয়েমেন। যে বছর (দাওয়াতের দশম বছর) আবু তালিব মারা যান, সে বছরই নবি করিম (সা) ইয়াসরিব থেকে আগত প্রথম দলটির সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। দলটি ছিল খাজরাজ গোত্রের; সাক্ষাতের পর সে দলের সবাই ইসলাম গ্রহণ করেন। এ বিষয়ে আলোচনার আগে আমরা এর মূল প্রেক্ষাপট বুআতের যুদ্ধ নিয়ে আলোচনা করব।

বুঝতের যুদ্ধ ছিল ইয়াসরিবের দুই আরব উপজাতি আউস ও খাজরাজের মধ্যে এক দশকেরও বেশি দীর্ঘ একটি যুদ্ধ। যুদ্ধটি শুরু হয়েছিল খুব সাধারণ কিছু ইস্যু নিয়ে দুই উপজাতির মধ্যে বিরোধ থেকে; যেমন: ভূমির অধিকার, পানির অধিকার ইত্যাদি। প্রথমে ছোটখাটো সংঘাত দেখা দেয়, ক্রমশ সেসব বাড়তে বাড়তে এক সময় বড় রকমের গৃহযুদ্ধের রূপ নেয় এবং তা শেষ হয় মুসলিমদের মক্কা থেকে ইয়াসরিবে হিজরতের চার-পাঁচ বছর আগে। অর্থাৎ খাজরাজ গোত্রের সঙ্গে নবিজির সাক্ষাতের আড়াই-তিন বছর আগেই বুআতের যুদ্ধের অবসান ঘটে।

সহিহ বুখারিতে বর্ণিত একটি হাদিস অনুসারে, আয়েশা (রা) বলেছেন, “বুআতের যুদ্ধটি ছিল নবিজির (সা) জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে আশীর্বাদস্বরূপ। এই যুদ্ধেই আউস ও খাজরাজ উভয় উপজাতির নেতৃস্থানীয় প্রায় সব ব্যক্তিই মারা যান।” জীবিতরা ছিলেন প্রধানত তরুণ। তাঁরা দশ বছর ধরে নিজেদের মধ্যে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ দেখতে দেখতে অধৈর্য হয়ে পড়েছিলেন। তাই তাঁরা নতুন কিছু চাইছিলেন যা তাঁদের জীবনকে অর্থবহ করে তুলবে। নিঃসন্দেহে প্রবীণদের চেয়ে তরুণেরা যে কোনো পরিবর্তন সহজে বরণ করে নিতে পারেন।

তবে যুদ্ধের পরে তাদের মধ্যেকার একজন উল্লেখযোগ্য বয়োজ্যেষ্ঠ সদস্য বেঁচে ছিল, তার নাম আবদুল্লাহ ইবনে উবাই ইবনে সালুল। বয়সের কারণে তার মধ্যে অহংকার জন্ম নেয়। বয়স্ক বলে সে স্বাভাবিকভাবেই মদিনার আরবদের অবিসংবাদিত নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠা পায়। আমরা দেখব, পরবর্তীকালে সে মুনাফেকদের নেতা হয়েছিল।

 

islamiagoln.com google news
আমাদের গুগল নিউজে ফলো করুন

 

ধারণা করা যায়, ইয়াসরিবের লোকদের সঙ্গে নবিজির (সা) সাক্ষাতের আগেই ইসলামের খবর তাদের কাছে পৌঁছেছিল। এ বিষয়ে সুয়ায়েদ ইবনুল সামিতের ঘটনাটি প্রণিধানযোগ্য। সুয়ায়েদ ছিলেন খাজরাজ উপজাতির একজন কবি। বুআতের যুদ্ধের আগে ইসলামের প্রাথমিক সময়ে যখন নবিজি (সা) শান্তি পূর্ণভাবে দাওয়াত দিচ্ছিলেন, তখন সুয়ায়েদ হজের উদ্দেশ্যে মক্কা যান। সেখানে তিনি নবিজি (সা) সম্পর্কে কুরাইশদের ছড়ানো গুজবগুলো (‘জাদুকর’, ‘কবি’ ইত্যাদি) শুনতে পান। তিনি নবিজির (সা) সঙ্গে দেখা করে বললেন, “আমি শুনেছি আপনি প্রাঞ্জল ভাষায় কিছু বাণী প্রচার করছেন। এরকম আমারও কিছু (বাণী) আছে।”

একথা শুনে নবিজি (সা) বললেন, “আপনার কী বাণী আছে আমাকে শোনান।” সুয়ায়েদ তাঁর লেখা প্রাক-ইসলামিক যুগের একটি উন্নতমানের ধ্রুপদি কবিতা আবৃত্তি করে শোনালেন। এবার নবিজি (সা) বললেন, “আপনার কাছে যা আছে তা ভালো, তবে আমার কাছে যা আছে তা আরও ভালো।” সুয়ায়েদ শুনতে চাইলে নবিজি (সা) পবিত্র কোরান থেকে তেলাওয়াত শুরু করলেন। তা শুনে সুয়ায়েদ একদম হতবাক। তিনি বললেন, “এর অর্থ তো বেশ গভীর। আমাকে এ নিয়ে একটু ভাবতে দিন।” তারপর সুয়ায়েদ ইয়াসরিবে ফিরে যান। কিন্তু সে বছরই বুআতের যুদ্ধে তিনি মারা যান। ইয়াসরিবের লোকেরা পরবর্তীকালে বলেছিল, “তিনি নিশ্চয়ই একজন মুসলিম হিসেবে মৃত্যুবরণ করেছেন।”

খাজরাজের এক যুবককে নিয়ে সেই সময়ের আরও একটি কাহিনি সিরাহ গ্রন্থগুলোতে আছে। তিনি যখন ইসলাম গ্রহণের সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছেন, তখন তাঁর গোত্রপ্রধান তাঁকে বললেন, “এই লোকের বিষয়ে তোমার ভাবার দরকার নেই। তুমি বরং নিজের চরকায় তেল দাও।” যা-ই হোক, সেই যুবকও ইয়াসরিবে ফেরার পর বুআতের যুদ্ধে মারা যান। জানা যায়, মৃত্যুর সময় তিনি তাসবিহ (সুবহানাল্লাহ), তাহমিদ (আলহামদুলিল্লাহ) ও তাকবির (আল্লাহু আকবার) পড়তে শুরু করেছিলেন। উল্লেখ্য, মুসলিমদের জন্য তখনও সেজনা, সালাহ ইত্যাদির বিধান চালু হয়নি।

 

ইয়াসরিনের একটি ছোট উপজাতি: খাজরাজ | ইয়াসরিবের জন্য বীজ রোপণ | মহানবী হযরত মুহাম্মদ ( সাঃ ) জীবন

 

ওপরের দুটি ঘটনায় আমরা দেখলাম, ইসলামের বাণী আগেই ইয়াসরিবে পৌঁছে গিয়েছিল। তবে প্রকৃত ধর্মান্তর শুরু হয় দাওয়াতের দশম বছরের জিলকদ অথবা জিলহজ মাসে। নবিজি (সা) আগের বছরের মতোই হয়ে আগত ব্যক্তিদের সঙ্গে মিনার আশেপাশে কথাবার্তা বলেন। কিন্তু এবার তিনি শুধু ইসলাম গ্রহণের আহ্বান জানালেন না, তাঁদের কাছে সাহায্য ও সুরক্ষা চাইতে লাগলেন। আমরা ওপরে বলেছি, নবিজি প্রথমে বড় উপজাতিগুলোর কাছে গেলেন; যেমন, বনু কিনদা, বনু শায়বান ইবনে সালাবা ইত্যাদি। কিন্তু ছোট উপজাতি বা গোত্রগুলোকে অগ্রাহ্য করেননি। তেমনই একটি উপজাতি ছিল ইয়াসরিবের খাজরাজ ।

নবিজি (সা) আকাবাতে (এখনকার মসজিদুল খাইফের কাছাকাছি স্থানে) একটি ছোট উপজাতির লোকদের পাথর নিক্ষেপ করতে দেখে জিজ্ঞেস করলেন আপনারা কারা? তাদের জবাব: আমরা খাজরাজ গোত্রের। [নবিজি (সা) ভাবলেন, এই খাজরাজ আবার কারা?’ তাঁকে এ বিষয়ে তথ্য দিয়ে সাহায্য করার জন্য আবু বকর (আ) সেই সেখানে ছিলেন না।] নবিজি (সা): আপনারা কি ইয়াসরিবের ইহুদিদের প্রতিবেশী?

তাদের জবাব: হ্যাঁ। নবিজি (সা): আমি কি আপনাদের সঙ্গে কথা বলতে পারি? তারা এবারও হ্যাঁ বললে নবিজি (সা) তাদের সামনে ইসলামের মূল বাণী ব্যাখ্যা করলেন, কুরআন তেলাওয়াত করলেন, তওহিদের ব্যাখ্যা করলেন এবং সবাইকে শিরক বিষয়ে সতর্ক করলেন। সেখানে খাজরাজরা ছিলেন মাত্র ছয়জন। তাঁদের কোনো তাঁবুও ছিল না, অর্থাৎ তাঁরা ততটা ধনী ছিলেন না। তবু নবিজি (সা) বড় গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে যেমন গুরুত্ব ও আন্তরিকতার সঙ্গে কথা বলেছিলেন, তাঁদের সঙ্গেও তাই করলেন। এখানে উল্লেখ্য, আউসদের তুলনায় খাজরাজরা অপেক্ষাকৃত অসচ্ছল ছিলেন। ছিলেন মূলত কৃষক ও মঞ্জুর। অন্যদিকে আউসদের বেশির ভাগই ছিলেন। ব্যবসায়ী।

আল্লাহর ইচ্ছা ছিল, এমন একটি অখ্যাত জনগোষ্ঠীর মাধ্যমেই ইসলাম উপকৃত হবে, যাদের কথা নবিজিও (সা) কল্পনা করেননি। এই উদাহরণ থেকে আমাদের শিক্ষণীয় হচ্ছে, যত তুচ্ছই হোক না কেন, কোনো সুযোগকেই ছোট করে দেখা উচিত নয়। নবিজি (সা) বড় ও অভিজাতদের দিকে মনোনিবেশ করলেও অন্যদের উপেক্ষা করেননি। তিনি খাজরাজদেরও একই রকম গুরুত্ব দিয়ে দাওয়াত দিয়েছিলেন। মক্কার অধিবাসীদের বাইরে এই ছয়জনই প্রথম ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন।

আরও পড়ুনঃ

Leave a Comment