কুরাইশদের বিরোধিতা | ব্যক্তিগত পর্যায়ে ইসলামের দাওয়াত | মহানবী হযরত মুহাম্মদ ( সাঃ ) জীবন

কুরাইশদের বিরোধিতা | ব্যক্তিগত পর্যায়ে ইসলামের দাওয়াত, কুরাইশরা বিভিন্নভাবে আল্লাহর রসুলের (সা) প্রকাশ্যে ইসলাম প্রচারের কাজে বিরোধিতা করেছিল:

কুরাইশদের বিরোধিতা | ব্যক্তিগত পর্যায়ে ইসলামের দাওয়াত | মহানবী হযরত মুহাম্মদ ( সাঃ ) জীবন

(১) বংশের সর্বোচ্চ নেতৃস্থানীয়র কাছে আবেদন 

প্রথমেই তারা কুরাইশ বংশের সেই সময়ের সর্বোচ্চ নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি আৰু তালিবের কাছে আবেদন করেছিল। এখানে একটা বিষয় লক্ষ করুন, মক্কায় তখন কোনো শাসক ছিল না। তারা একক কোনো শাসক নিয়োগ করতে আগ্রহী ছিল না। তারা সমাজের বয়োজ্যেষ্ঠ ব্যক্তিদের সমন্বয়ে ‘দার আল-নানওয়া’ নামে একটা কমিটি গঠন করেছিল। কিন্তু নির্দিষ্ট কোনো ব্যক্তি সেটার নেতৃত্বে ছিলেন না। তবে তারা সমাজের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোতে ভূমিকা রাখত।

মক্কার প্রতিটি উপগোত্রের প্রতিনিধিরা ছিল দার আল-নাদওয়ার সদস্য। প্রতিটি উপগোত্রের একজন করে নেতা (সর্দার) ছিল; যেমন, বনু হাশিম, বনু মাখতুম, বনু আবদ আল দার প্রমুখ সবারই নেতা ছিল। উপগোত্রের অভ্যন্তরীণ বিষয়গুলো সংশ্লিষ্ট নেতার নির্দেশনা অনুযায়ী নির্ধারিত হতো। বনু হাশিমের নেতা ছিলেন আবু তালিব। তৎকালীন আরবদের রীতি অনুসারে নেতা নির্ধারিত হতেন বংশানুক্রমিকভাবে, এর কোনো হেরফের হতো না। গোত্রের সবাই নেতার কথা মেনে চলত, সবাই তাঁকে সম্মান করত। নেতা মারা গেলে তার একজন পুত্র গোত্রের দায়িত্ব গ্রহণ করতেন। যেমন, আবদুল মুত্তালিব মারা গেলে তাঁর পুত্রদের একজন, আবু তালিব দায়িত্ব গ্রহণ করেন।

 

কুরাইশদের বিরোধিতা | ব্যক্তিগত পর্যায়ে ইসলামের দাওয়াত | মহানবী হযরত মুহাম্মদ ( সাঃ ) জীবন

 

নবি করিম (সা) যখন প্রকাশ্যে ইসলাম প্রচার শুরু করেন, তখন সমাজের কিছু ব্যক্তি আবু তালিবের কাছে যান। প্রথমে তাঁকে নম্রভাবে “হে আবু তালিব, আপনার ভাতিজা আমাদের প্রতিমাগুলোকে অভিশাপ নিচ্ছে, এক নতুন ধর্ম প্রচার করছে। নিশ্চয়ই আপনি এটা হতে দিতে পারেন না।” আবু তালিব সরাসরি কোনো সংঘাতে জড়াতে চাননি, তাই তিনি তাদের ভদ্রভাবে কিছু কথা বলে বিদায় করেন। তিনি ভেবেছিলেন বিষয়টা আর বেশি দূর এগোবে না। কিন্তু তা হয়নি। কয়েক সপ্তাহ পরে তারা আবার আবু তালিবের কাছে গিয়ে একই নালিশ করেন।

তখন লোকজন একের পর এক নতুন ধর্মটি গ্রহণ করছিল। তা ছাড়া হাজিরা হজ করে নিজ নিজ এলাকায় ফিরে যাচ্ছিল এই খবরটি নিয়ে যে, ‘মক্কার এক লোক নতুন এক ধর্ম প্রচার করছে।’ কুরাইশদের নেতৃস্থানীয়রা বুঝতে পারছিল, এবার তাদের কোনো একটা পদক্ষেপ নিতেই হবে। তাই তারা আবু তালিবের ওপর চাপ বাড়িয়ে দিল। তারা তাকে কিছুটা হুমকি দিয়েই বলল, “আপনার ভাতিজা আমাদের পিতৃপুরুষদের অবমাননা করছে। আমরা আর এটা সহ্য করতে পারি না।”

এখানে কুরাইশরা ছোট একটা বিষয়কে বড় ও বিকৃতভাবে উপস্থাপন করেছিল। এখানে বলা প্রয়োজন, আমাদের সময়েও ইসলামের বিরোধিতাকারীরা এ রকম করে থাকে; তারা একটা ছোট্ট বিষয়কে এত বড় করে তোলে যেন পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাবে। নবি করিম (সা) কিন্তু তাদের পূর্বপুরুষদের কখনোই কোনো অভিশাপ দেননি, কারণ তাঁরা তাঁর নিজেরও পূর্বপুরুষ। তিনি শুধু আল্লাহর একত্ববাদ বা তাওহিদের প্রচার করছিলেন। নবিজি (সা) হয়তো বলেছেন, ‘প্রতিমাপূজা ভালো কিছু নয়, এটা নির্বুদ্ধিতা।’ কুরাইশরা এই কথাটিকেই অতিরঞ্জিত করে এভাবে অর্থ দাড় করায়: “আচ্ছা, যদি এটা নির্বুদ্ধিতা হয় তাহলে এর অর্থ হলো আমাদের পিতৃপুরুষেরা নির্বোধ ছিল, আর যদি তারা নির্বোধ হয় তাহলে এর অর্থ তুমি তাদের অভিশাপ দিচ্ছ’ ইত্যাদি ইত্যাদি।

আবু তালিবের কাছে তাদের আরও একটা অভিযোগ ছিল, “আপনার ভাতিজা আমাদের প্রতিমাগুলোকে অভিশাপ দিচ্ছে।” নবিজি (সা) কিন্তু তাদের প্রতিমাগুলোকে কখনও অভিশাপ দেননি। আল্লাহ পবিত্র কোরানে বলেছেন: “আর তারা আল্লাহ তায়ালার বদলে যাদেরকে ডাকে, তোমরা তাদেরকে গালিগালাজ করো না, নইলে তারা সীমালঙ্ঘন করে অজ্ঞানতাবশত আল্লাহকেও গালি দেবে। ”

[সুরা আনআম, ৬:১০৮] অথচ তারা নবিজিকে (সা) অভিযুক্ত করেছিল তাদের প্রতিমাগুলোকে অভিশাপ দেওয়ার অভিযোগে। এ বিষয় নিয়ে তারা আবু তালিবের কাছে আরো বলে, “আপনার ভাতিজা যা করছে আমরা তা আর সহ্য করতে পারছি না। আপনি হয় তাকে এ জাতীয় কাজকর্ম থেকে বিরত রাখুন, নতুবা আমাদের হাতে তাকে সোপর্দ করুন। তার ব্যাপারে আমরা যা করার করব।”

আবু তালিব এর আগে কখনও তাঁর গোত্রের লোকদের কাছ থেকে এই ধরনের আচরণের মুখোমুখি হননি।

[আনুষঙ্গিক বিষয়: নেতৃত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য নেতাদের অনুসারীর প্রয়োজন হয়, তাঁদের নেতৃত্ব অনুসারীদের ওপর নির্ভরশীল। তাই তাঁরা বাহ্যিকভাবে শক্তিশালী হলেও তাঁদের এক ধরনের দুর্বলতা থেকেই যায়। প্রত্যেক নেতাকেই নিজের লোকদের সন্তুষ্ট রাখতে হয়। এমনকি একজন অত্যাচারী শাসকও নিজের কিছু মানুষকে খুশি রাখতে নানা রকমের সুযোগ-সুবিধা দেন, তাদের ভুলত্রুটি উপেক্ষা করেন। শুধু আল্লাহই ‘আল-মালিক’, সত্যিকারের রাজা। অন্য সব রাজাকে চারপাশের মানুষের (যেমন: মন্ত্রী, উজির, সেনাবাহিনী ইত্যাদি) ওপর নির্ভর করে টিকে থাকতে। নিজের লোকেরা তাদের বিরুদ্ধে চলে গেলে তাদের আর কোনো ক্ষমতা থাকে না।]

এমন অভিজ্ঞতা আবু তালিবের আগে কখনও হয়নি। আরবদের বিধান অনুসারে তারা নেতার অনুমতি ছাড়া নিজের গোত্রের কারো ক্ষতি করতে পারে না। এই বিধান না মানলে তাদের অন্য গোত্রের মানুষদের কাছে লজ্জা ও উপহাসের মুখোমুখি হতে হয়। অতএব আবু তালিব মুহাম্মদকে (সা) তাদের হস্ত ান্তর না করা পর্যন্ত তারা কিছুই করতে পারছিল না। এ কারণেই তারা আবু তালিবের কাছে গিয়ে ওইসব দাবি জানাতে থাকে।

এই পর্যায়ে আবু তালিব মুহাম্মদের (সা) কাছে গিয়ে তাঁকে বললেন, “হে আমার ভাতিজা! আমার লোকেরা আমার কাছে এসেছিল এবং এই ধরনের কথা বলেছে। এমতাবস্থায় তুমি আমার প্রতি দয়া করো। আমাকে এমন কোনো পরিস্থিতির মধ্যে ফেলো না, যা আমি সহ্য করতে পারব না।” এটা আবু তালিবের পক্ষ থেকে এক ধরনের ‘ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল’ করার শামিল, নবিজির (সা) পক্ষে তা মোকাবিলা করা সত্যিই কঠিন ছিল। আবু তালিব ভাতিজা মুহাম্মদকে (সা) নিজের সন্তানদের চেয়েও বেশি ভালোবাসতেন। আগেও উল্লেখ করেছি, আবু তালিব ছিলেন নবিজির (সা) আপন চাচা। নবিজিরও (সা) তাঁর প্রতি বাবার মতোই ভালোবাসা ছিল। আবু তালিব মুহাম্মদের (সা) কাছে অনুনয়-বিনয় করে বলেন, “আমাকে দয়া করো। আমি এখন বৃদ্ধ হয়েছি। আমি আর কতটা সহ্য করতে পারি?”

এই কঠিন মনস্তাত্ত্বিক চাপ সত্ত্বেও নবিজি (সা) বলেন, “হে আমার চাচা,আল্লাহর শপথ! তারা যদি আমাকে আমার ডান হাতে সূর্য ও বাম হাতে চাঁদ তুলে দেয়, তবু আমি যতক্ষণ না পর্যন্ত সফল হই বা মৃত্যুবরণ করি ততক্ষণ পর্যন্ত আমার আল্লাহর বাণী প্রচার করে যাব।” অন্য এক বর্ণনায় (যা সম্ভবত আরও সঠিক) আছে, তিনি তাঁর চাচাকে বলেছিলেন, “হে আমার চাচা, আপনি কি সূর্য দেখছেন?” আবু তালিব হ্যাঁ-সূচক জবাব দিলে নবিজি (সা) বলেন, “আল্লাহর শপথ! আপনি যেমন সূর্যের আলোয় আপনার লাঠিকে আলোকিত হওয়া থেকে বিরত রাখতে পারেন না, আমি আল্লাহর বাণী প্রচার করা থেকে বিরত থাকতে তার চেয়েও বেশি অক্ষম।”

আবু তালিবের কাছে নবিজির (সা) ওই জবাবের দুটি প্রতীকী অর্থ থাকতে পারে। তিনি হয়তো বোঝাতে চেয়েছেন:

(ক) ‘ইসলামের আলো সূর্য ও চাঁদের চেয়ে উজ্জ্বল। আমি এটা নেভাতে পারি না। তারা যদি আমাকে এইসব (সূর্য ও চাঁদের আলো এনে দেয়, তবুও আমার কাছে যে (ইসলামের) আলোক আছে তা বেশি উজ্জ্বল। এটি কখনই নিভে যাবে না।

(খ) “তারা যদি আমাকে এই পৃথিবীর বাইরেরও (সূর্য ও চাঁদ) কোনো কিছু এনে দেয়, তবু আমি আমার মৃত্যু আসা অথবা আমার বার্তা প্রচারে সফল হওয়া অবধি আমি যা করছি তা থেকে সরে আসতে পারব না।’

আবু তালিব তার ভাতিজা মুহাম্মদের (সা) মধ্যে এই দৃঢ়প্রতিজ্ঞ নিষ্ঠা ও আন্তরিকতা দেখে বললেন, “হে আমার ভাতিজা, তুমি যা করতে চাও তা করে যাও। আল্লাহর কসম, আমি তোমাকে আর কখনও বাধা দেব না। নিজেকে রক্ষা করার ক্ষমতা আমার আছে।”

 

কুরাইশদের বিরোধিতা | ব্যক্তিগত পর্যায়ে ইসলামের দাওয়াত | মহানবী হযরত মুহাম্মদ ( সাঃ ) জীবন

 

(২) আবু তালিবের কাছে (শঠতামূলক) দর কষাকষির প্রস্তাব

লোকেরা যখন শুনল যে আবু তালিব চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছেন, তখন তারা আবার তার কাছে ফিরে গেল। কিন্তু এবার শুধু বনু হাশিম নয়, কুরাইশদের বিভিন্ন গোত্রের প্রতিনিধিদের সঙ্গে নিয়ে হাজির হল। এটি ছিল বয়কট করার জন্য অন্তর্বর্তী পদক্ষেপ। বিয়কট নিয়ে আমরা ১৮তম পর্বে বিস্তারিত আলোচনা করব। তারা আপাতত তাকে বলল, “আমরা একটি প্রস্তাব নিয়ে এসেছি। আমরা এখানকার সবচেয়ে সম্ভ্রান্ত যুবক আল-ওয়ালিদ ইবনুল মুগিরার পুত্র আল-উমরকে আপনার জন্য ঠিক করেছি।

আমরা এক পুত্রের সঙ্গে অন্য এক পুত্রের বদল করব। আমরা আল-উমর ইবনে আল-ওয়ালিদকে আপনার পুত্র হিসেবে আপনার কাছে হস্তান্তর করব। বিনিময়ে আপনি আপনার ভাতিজাকে আমাদের হাতে সোপর্দ করবেন এবং তাকে নিয়ে আমরা যা খুশি তাই করব।” এ কথা শুনে আবু তালিব খুব রেগে গিয়ে বললেন, “এ তোমাদের কেমন অশুভ এবং শঠটাপূর্ণ পর কষাকষি। এ কেমন মূর্খের মতো কাজ! তোমরা কি চাও যে আমি তোমাদের একটি ছেলেকে যত্নআত্তি করে, খাইয়ে-দাইয়ে মোটাতাজা করি, আর তোমরা আমার ছেলেকে মেরে ফেল?”

এ পর্যায়ে মুর্তিম ইবনে আদি উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, “হে আবু তালিব, আমি মনে করি লোকেরা তোমার সঙ্গে যতটা সম্ভব ভদ্রভাবে আচরণ করেছে। তোমাকে অবশ্যই তাদের একটি প্রস্তাব মেনে নিতে হবে।” মুতিম ইবনে আদি ছিলেন সেই সময়ের মক্কার সবচেয়ে বয়োজ্যেষ্ঠ ব্যক্তি। তিনিই ছিলেন সেই ব্যক্তি, যিনি কালো পাথর (‘ব্ল‍্যাক স্টোন’) নিয়ে বিবাদ নিরসনের পদ্ধতি প্রস্তাব করার প্রস্তাবটি ছিল: কাবায় যে আগে প্রবেশ করবে] মধ্য দিয়ে কাবার চত্বরে রক্তপাত এড়াতে পেরেছিলেন। তিনি ছিলেন কুরাইশদের মধ্যে ইসলামের প্রতি সবচেয়ে কম শত্রুভাবাপন্ন ব্যক্তি। তাই মুতিম ইবনে আদির আবু তালিবের বিপক্ষে অবস্থান নেওয়া গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বলা যেতে পারে, সেই মুহূর্তে পুরো মক্কাই আৰু তালিবের বিরুদ্ধে। মুর্তিম আবু তালিবকে বললেন, “তুমি ওদের কাছ থেকে আর কী আশা করো?”

[প্রাসঙ্গিকতার খাতিরে একটু ভবিষ্যতের দিকে যাই। নবি করিম (সা) বদরের যুদ্ধের পরে মুতিম একজন পৌত্তলিক হওয়া সত্ত্বেও তাঁর অনেক প্রশংসা করে বলেছিলেন: আজ যদি মুর্তিম ইবনে আদি বেঁচে থাকতেন এবং তিনি এই ৭২ জন যুদ্ধবন্দির মুক্তির জন্য একটি কথাও আমাকে বলতেন, তাহলে আমি তাঁর জন্যই সব বন্দিকে মুক্তি নিতাম।

 

islamiagoln.com google news
আমাদের গুগল নিউজে ফলো করুন

 

মুতিম ইবনে আদি মুসলিম না হয়েও ইসলামের পক্ষে অনেক কিছু করেছিলেন। অবশ্য তিনি এখন আল্লাহর রসুলের (সা) দাওয়াতের বিরুদ্ধে অবস্থান নিচ্ছেন, সম্ভবত এটিই তাঁর সবচেয়ে খারাপ কাজ ছিল। পরবর্তী দশ বছরে আমরা দেখতে পার, তিনি মুসলিমদের জন্য প্রচুর ইতিবাচক কাজ করেছেন। এ কারণেই নবিজি (সা) তাঁর এতটা প্রশংসা করেছিলেন। অতএব দেখা যাচ্ছে, কিছু কিছু অমুসলিম ছিল যারা ভালো এবং সত্যই আন্তরিক। সব অমুসলিমকে একই রকম মনে করার কোনো কারণ নেই। এমন অনেক অমুসলিম আছে যারা মানবাধিকারের পক্ষে অত্যন্ত সোচ্চার। আমাদের উচিত হবে তাদের প্রশংসা করা, যেমনটি নবিজি (সা) মুতিম ইবনে আদি সম্পর্কে করেছিলেন।]

মুতিম ইবনে আদি আবু তালিবকে আরও বললেন, “ওদের প্রস্তাবিত এই বিকল্পগুলোর মধ্য থেকে তুমি যে কোনো একটি বেছে নাও। তুমি আমাদের কাছ থেকে আর কী চাও?” পরিস্থিতি এমন যে, আক্ষরিকভাবেই আবু তালিব বনাম পুরো মক্কা। এবার আবু তালিব অবিশ্বাস্য রকমের সাহসী রূপ ধারণ করলেন। তিনি মুতিম ইবনে আদিকে সরাসরি বললেন, “হে মুতিম, আপনি এখন যে প্রকাশ্য ভূমিকা নিলেন তার পরিকল্পনা তো আপনি অনেক আগে থেকেই করে রেখেছিলেন!” তারপর বললেন, “আপনারা যা খুশি তাই-ই করুন, আমি আমার অবস্থান থেকে নড়ব না।” এটা ছিল আক্ষরিক অর্থেই পুরো কুরাইশদের সামনে নিজের সম্মান ও মর্যাদা রক্ষা করার বিষয়। আবু তালিব তা বেশ সাহসিকতার সঙ্গেই করেছিলেন।

এখানে উল্লেখ্য, আবু তালিব কবিতা লিখতেন। তিনি ছিলেন কুরাইশদের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি। তাঁর কবিতা ছিল গভীর ও অন্তর্নিহিত ভাববোধসম্পন্ন। তাঁর কবিতা ইবনে ইসহাক, ইবনে হিশাম, ইবনে সাদসহ অনেকের গ্রন্থে লিপিবন্ধ আছে। এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে তিনি তাঁর স্বজনদেরকে উদ্দেশ করে নিন্দাসূচক বেশ কয়েকটি কবিতা লেখেন। কবিতায় নিজেদের জীবনবোধের বৈপরীত্য তুলে ধরে অভিযোগ করেন যে, তারা নিজেদের আত্মীয়দের যথাযথ সম্মান করছে না। আবু তালিবের আক্ষরিক অর্থে কোনো ক্ষমতা না থাকা সত্ত্বেও কুরাইশরা তাঁকে আর ঘাঁটায়নি। তবে তাঁর গভীর মর্যাদাবোধ, আন্তরিকতাও বিশ্বাসের দৃঢ়তা তাঁকে এ যাত্রায় জিতিয়ে দেয়। এই একটি ঘটনার মধ্য দিয়ে আমরা আবু তালিবের প্রজ্ঞার পরিচয় পাই।

নবি করিম (সা) আবু তালিবকে অনেক ভালোবাসতেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও আবু তালির ইসলাম গ্রহণ করেননি। এটা সিরাহ-এর পরবর্তী পর্যায়ে ঘটনা। আৰু তালিব যখন মৃত্যুশয্যায়, নবিজির (সা) বয়স তখন ৫০-৫১ বছর। মৃত্যুপথযাত্রী প্রাণপ্রিয় চাচার কাছে নবিজি (সা) সনির্বন্ধ অনুরোধ রাখলেন, “হে আমার চাচা, আমি আপনাকে মিনতি করে বলছি, আপনি একবারের জন্য হলেও ‘কালেমা’ (লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ) বলুন, যাতে আমি আল্লাহর দরবারে আপনাকে বাঁচাতে সুপারিস করতে পারি।” আবু তালিব মনে মনে জানতেন যে কালেমার এই বাণী সত্য।

 

কুরাইশদের বিরোধিতা | ব্যক্তিগত পর্যায়ে ইসলামের দাওয়াত | মহানবী হযরত মুহাম্মদ ( সাঃ ) জীবন

 

তিনি মুহাম্মদের (সা) নবুয়ত-সংক্রান্ত অনেক লক্ষণ ও অলৌকিক ঘটনার সাক্ষী ছিলেন, যা থেকে খুব ভালো করেই জানতেন যে তাঁর ভাতিজা কোনো মিথ্যা বলেননি। কিন্তু আরেকটি ব্যাপার ছিল তাঁর কাছে আরও বেশি মূল্যবান। তা হলো তাঁর পিতা, বংশ ও প্রতিপত্তি। তিনি ছিলেন সেই আরবদের সবচেয়ে বিখ্যাত ব্যক্তি আবদুল মুত্তালিবের পুত্র। আর বংশমর্যাদাই ছিল আরবদের সংস্কৃতির অন্যতম উপাদান, যা আবু তালিবের জীবনের মুহূর্ত পর্যন্ত তাঁর ইসলাম ধর্ম গ্রহণে বাধা হিসেবে কাজ করেছিল।

আল্লাহর রসুলের অনুরোধে আবু তালিব যখন কালেমা বলতে যাচ্ছিলেন, তখন পাশে দাঁড়িয়ে থাকা আবু জেহেল তাঁকে বললেন, “তুমি কি তোমার পিতার ধর্ম ত্যাগ করতে যাচ্ছ?” এ কথা শোনার পর আবু তালিবের মুখ বন্ধ হয়ে যায়। ঠিক সেই সময়েই ‘মালাক আল-মওত’ (মৃত্যুর ফেরেশতা) এসে তাঁর রুহ নিয়ে নেন। তিনি শেষ পর্যন্ত আর কালেমা বলতে পারলেন না! প্রাণপ্রিয় চাচার এহেন মৃত্যুতে নবিজি (সা) আবেগপ্রবণ হয়ে বলে ফেলেছিলেন, “অনুমতি না থাকলেও আমি আপনাকে ক্ষমার জন্য আল্লাহকে অনুরোধ করব।”

এখানে একটা বিষয় উল্লেখ্য, কোনো নবি আল্লাহর অনুমতি ছাড়া কিছু করতে পারেন না। কারণ নবিরা আল্লাহর বাণী ও শরিয়তের প্রতিনিধিত্ব করেন। ইউনুসের (আ) প্রতি আল্লাহ যা করেছিলেন তা কেন করেছিলেন? এ কারণে যে ইউনুস (আ) আল্লাহ তায়ালার অনুমতি ছাড়াই তাঁর লোকদের রেখে চলে গিয়েছিলেন। নবি করিম (সা) আল্লাহর অনুমতি ছাড়া কিছুই করতেন না। তবে আপন চাচার ক্ষেত্রে তিনি অত্যধিক আবেগতাড়িত হয়ে আল্লাহ অনুমতি ছাড়াই ক্ষমা প্রার্থনা করেন। এ বিষয়ে আল্লাহ কোরানে একাধিক আয়াত নাজিল করেন। একটি হলোঃ

“নিকট-আত্মীয় হলেও মুশরিকদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করা নবি ও মুমিনদের জন্য সংগত নয়।” [সুরা তওবা, ৯:১১৩] আরেকটি হলো।

“তুমি যাকে ভালোবাসো (ইচ্ছা করলেই) তাকে তুমি সৎপথে আনতে পারবে না; তবে আল্লাহ যাকে ইচ্ছা সৎপথে আনেন, আর তিনিই ভালো জানেন কারা সৎপথ অনুসরণ করে।” [সুরা কাসাস, ২৮:৫৬]

আরো পড়ুনঃ

Leave a Comment