রাখাল বালক মুহাম্মদ (সা) | মহানবি মুহাম্মদের (সা) কৈশোর ও যৌবনের কাল | মহানবী হযরত মুহাম্মদ ( সাঃ ) জীবন

রাখাল বালক মুহাম্মদ (সা) | মহানবি মুহাম্মদের (সা) কৈশোর ও যৌবনের কাল, এ পর্যায়ে আমরা মহানবি মুহাম্মদের (সা) কৈশোরের (১৪-১৫ বছর) এবং যৌবনের (২০ বছর) সময়ের কিছু ঘটনা নিয়ে আলোচনা করব। যেমনটি আমরা আগেও বেশ কয়েকবার উল্লেখ করেছি, মহানবির (সা) এই বয়সের ঘটনাবলি সম্পর্কে আমাদের কাছে খুব সামান্যই তথ্য আছে। তথ্য কম থাকার কারণ কিছুটা ব্যাখ্যা করছি: ক) কেউই ঘটনা দেখেনি এবং রেকর্ড করেনি;

খ) কেউই জানত না যে তিনি আল্লাহর নবি হতে চলেছেন;

গ) সেই সময় মক্কায় কোনো কিছু লিখে রাখার প্রচলন ছিল না;

ঘ) ঘটনা বর্ণনা করার জন্য দীর্ঘকাল বেঁচে থাকা মানুষের সংখ্যাও খুব কম ছিল। 

 

রাখাল বালক মুহাম্মদ (সা) | মহানবি মুহাম্মদের (সা) কৈশোর ও যৌবনের কাল | মহানবী হযরত মুহাম্মদ ( সাঃ ) জীবন

 

রাখাল বালক মুহাম্মদ (সা) | মহানবি মুহাম্মদের (সা) কৈশোর ও যৌবনের কাল | মহানবী হযরত মুহাম্মদ ( সাঃ ) জীবন

 

আমাদের জানা মতে, মহানবি মুহাম্মদের (সা) জীবনের প্রথম কাজটি ছিল রাখালের। এটি বুখারির একটি সহিহ হাদিসে লিপিবদ্ধ আছে। নবিজি (সা) বলেছেন, “আল্লাহ কখনো রাখাল না করে কোনো নবিকে প্রেরণ করেননি। (অর্থাৎ সব নবিই পেশা হিসেবে এক সময় রাখালের কাজ করেছেন।) এক সাহাবি জিজ্ঞেস করলেন, “হে আল্লাহর রসুল! এমনকি আপনিও (রাখালের কাজ করেছেন)?” এ থেকে বোঝা যায় যে, নবিজির (সা) কিশোর জীবনের অন্যান্য খুঁটিনাটি ঘটনা জানা তো দূরের কথা, অনেক সাহাবি এটুকুও জানতেন না যে তিনি রাখালের কাজ করেছেন। সাহাবিরা ভেবেছিলেন যে তিনি নিশ্চয়ই অন্য নবিদের থেকে ব্যতিক্রম হবেন। কিন্তু তিনি জবাব দিয়েছিলেন, “হ্যাঁ, আমিও রাখাল ছিলাম। আমি অর্থের বিনিময়ে মক্কার মানুষদের মেষ চরাতাম।”

অন্য এক হাদিসে আছে, নবিজি (সা) একবার কিছু রাখালকে মেষ চরাতে দেখে বলেছিলেন, “আমি তোমাদের পরামর্শ দিচ্ছি, আরাকের (একটি বিশেষ ধরনের গাছ) ঘন শাখা খুঁজে বের করো, তা তোমাদের মেষগুলোর জন্য বেশ উপকারী হবে।” মেষপালকেরা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, “আপনি কীভাবে এটি জানেন?” জবাবে তিনি বললেন, “আমি একসময় রাখাল ছিলাম; এবং আল্লাহর প্রত্যেক নবিই রাখাল ছিলেন ।”

অন্য একটি বর্ণনা অনুসারে, তিনি বলেছেন, “মুসা (আ) ও দাউদকে (আ) যখন নবি হিসেবে মনোনীত করা হয়েছিল তখন তাঁরা রাখাল ছিলেন। আমিও তেমনি আজিয়াদ উপত্যকায় রাখাল ছিলাম।” আল্লাহ তায়ালা চাইলে মহানবিকে (সা) অনেক বিত্ত-বৈভবের মধ্যে বড় করতে পারতেন। কিন্তু বাস্তবে আমরা কী দেখতে পাই? নবিজি (সা) অত্যন্ত সাধারণ, নিম্ন মজুরির, সবচেয়ে কঠিন কাজ দিয়েই তাঁর জীবন শুরু করেছিলেন। তাঁর এই কঠিন কাজের মধ্য দিয়ে জীবন শুরু করার অনেক গভীর তাৎপর্য আছে; সেগুলোর কিছু কিছু আমরা আলোচনা করব:

  • ১) একজন রাখালের নির্জনে নিজেকে নিয়ে চিন্তাভাবনা করার সুযোগ তৈরি হয়। সে তার মেষের পাল চরাতে চরাতে জীবনের উদ্দেশ্য সম্পর্কে চিন্তা, ধ্যান এবং অনুধাবন করার সুযোগ পায়। চাকরি-বাকরি আর দুনিয়াদারি নিয়ে সব সময় ব্যস্ত থাকলে আধ্যাত্মিকতা চর্চার সময় কোথায়? তাই ধনী দেশগুলোতে এবং উচ্চ আয়ের মানুষদের মধ্যে স্বাভাবিকভাবেই আমরা নাস্তিকতা বেশি দেখতে পাই। অন্যদিকে কৃষক কিংবা খেটে খাওয়া গরিব মানুষদের মধ্যে আমরা ধার্মিকতার উপস্থিতি লক্ষ করে থাকি।আপনি যখন মেষ চরাচ্ছেন, যখন সৃষ্টিকর্তার দান অবারিত প্রকৃতি আপনি গভীরভাবে দেখছেন, পর্যবেক্ষণ করছেন, তখন আপনি নাস্তিক হবেন কীভাবে? প্রকৃতিগত ‘ফিতরা’র কারণেই আপনার পক্ষে নাস্তিক হওয়া সম্ভব হবে না। সৃষ্টিকর্তার প্রতি এমনিতেই আপনার বিশ্বাস এসে যাবে। অন্যদিকে জাগতিক বিষয়াদি নিয়ে নিমগ্ন ব্যস্ত নাগরিক জীবনে অভ্যস্ত মানুষের হৃদয় এমনিতেই শক্ত হয়, তাই নাস্তিকতা তাকে সহজেই পেয়ে বসে।
  • ২) মেষকে মানুষের সঙ্গে অনেকটা তুলনা করা যায়। তাদের দিকে ঠিকমতো খেয়াল রাখা দরকার; অন্যথায় তারা ভুল পথে যেতে পারে। প্রতিটি প্রাণীরই কিছু স্বভাবজাত বৈশিষ্ট্য থাকে যা রাখাল সহজেই বুঝতে পারে। প্রতিটি প্রাণীকেই তাদের নিজস্ব বৈশিষ্ট্য ও প্রয়োজন অনুযায়ী যত্ন নিতে হয়। দেখা যায়, একটি পালের মধ্যে কিছু মেষ অনড়, আর কিছু নরম প্রকৃতির হতে পারে। কেউ কেউ নিজে নিজেই পথ চিনতে পারে, কেউ কেউ শুধু অন্যদের অনুসরণ করে। রাখাল কিন্তু প্রতিটি মেষের স্বভাব আলাদাভাবে বুঝতে পারে এবং সে অনুযায়ী প্রতিটির প্রাণীর দিকে আলাদাভাবে নজর রাখে। একজন সত্যিকারের নেতারও এই গুণটি থাকা দরকার। আর আল্লাহর নবিদের জন্য এই গুণ তো অত্যাবশ্যকীয়।

 

islamiagoln.com google news
আমাদের গুগল নিউজে ফলো করুন

 

  • ৩) একজন রাখাল স্বভাবে একদিকে যেমন কোমল ও স্নেহময়, অন্যদিকে তেমনি নির্ভীক। সে তার নিজের দেখভাল করা প্রাণীর প্রতি কোমল ও স্নেহময়, কিন্তু অন্য জন্তু-জানোয়ার যা তার পশুর ওপর আক্রমণ করতে পারে, তাদের বিরুদ্ধে সে কঠোর ও নির্ভীক। নবিজি (সা) বলেছিলেন, “যেসব মানুষ ঘোড়ার। মালিক, তারা অহংকারী হয়; যারা উটের মালিক, তারা উদ্ধত হয়। আর যারা মেষের মালিক, তারা বিনয়ী হয়।” এটা আসলেই সত্য। এ কারণেই আল্লাহ প্রত্যেক নবির জন্য রাখাল পেশা নির্ধারিত করে রেখেছিলেন। অতএব নবিজি (সা) যে অত্যন্ত কোমল স্বভাবের ছিলেন তা খুবই স্বাভাবিক, কোনো কাকতালীয় ব্যাপার নয়। 
  • ৪) নবিজি (সা) অনুধাবন করতে পেরেছিলেন যে, তাঁকে যেমন নিজের পায়ে পাড়াতে হবে, তেমনি তাঁর চাচা আবু তালিবকেও আর্থিকভাবে সাহায্য করতে হবে। তাই তাঁর অর্থ-উপার্জনের প্রয়োজন ছিল।
  • ৫) আমরা দেখতে পাচ্ছি যে নবিজি (সা) সহজ-সরল জীবনযাত্রায় অভ্যন্ত ছিলেন। তিনি খুব কঠিন ও স্বল্প বেতনের কায়িক শ্রমের কাজ করতেন। এটি আমাদের জন্য শিক্ষা যে, অর্থ-উপার্জনের জন্য কাজ করার মধ্যে কোনো অসম্মান নেই। নবিজি (সা) বলেছেন, “শুদ্ধতম অর্থ-উপার্জন হচ্ছে যা তুমি নিজের হাতে কায়িক শ্রমের মধ্য দিয়ে উপার্জন কর।” দাউলও (আ) এমনটি করতেন; তিনি ছিলেন লোহার ও কাঠের কারিগর।
  • ৬) এ থেকে আমরা আরও দেখতে পাই, নবি হওয়ার পরও নবিজি (সা) মানুষের কাছে তাঁর অতি সাধারণ অতীত জীবন সম্পর্কে বর্ণনা দিতে বিন্দুমাত্র বিব্রত হননি। এভাবেই নিচ থেকে শুরু করে উঁচুতে যাওয়া উচিত। নিচ বা ‘ক্যাচ’ থেকে শুরু করলে আপনি যতটা সফল হবেন, উঁচু থেকে (জন্মসূত্রে বা অন্য কোনোভাবে পেয়ে) শুরু করলে অতটা সফল নাও হতে পারেন। এ কথা ব্যাবসার ক্ষেত্রে যেমন প্রযোজ্য, তেমনি ধর্মের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। বাস্তব উদাহরণ হিসেবে পৃথিবীর সর্বাধিক সফল উদ্যোক্তাদের (যেমন বিল গেটস, স্টিভ জবস ইত্যাদি) দেখুন। তাঁরা সবাই নিচ থেকেই শুরু করেছিলেন; এবং তারাই এক সময় বিশাল ব্যবসায়িক সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছেন। একই কথা মহানবির (সা) জন্যও প্রযোজ্য। তিনি নিচ থেকে শুরু করে জীবনের প্রতিটি ধাপের মধ্য দিয়ে গিয়ে সাফল্যের শীর্ষে পৌঁছেছিলেন। এভাবে যখন আপনি শীর্ষে পৌঁছবেন, তখন আল্লাহ তায়ালাও এতে বরকত দান করবেন। অন্যদিকে যদি আপনি কোনো চেষ্টা কিংবা শ্রম ছাড়াই কিছু পেয়ে যান, তাহলে আপনি সেটার গুরুত্ব ততটা অনুধাবন করতে পারবেন না।

 

রাখাল বালক মুহাম্মদ (সা) | মহানবি মুহাম্মদের (সা) কৈশোর ও যৌবনের কাল | মহানবী হযরত মুহাম্মদ ( সাঃ ) জীবন

 

আরো পড়ুনঃ

 

Leave a Comment