শয়তানের চিৎকার | মদিনায় প্রাথমিক পর্যায়ে হিজরত, এর আগের পর্বে আমরা নবি করিমের (সা) সঙ্গে ইয়াসরিবের লোকদের দুটি অঙ্গীকার নিয়ে আলোচনা করেছি। প্রথম ও দ্বিতীয় অঙ্গীকারের মধ্যে মূল পার্থক্যটি হলো: প্রথমটি ছিল শুধু ধর্মীয় বিষয়ে অঙ্গীকার, আর দ্বিতীয়টি ছিল ধর্মীয় বিষয়ের পাশাপাশি সুরক্ষা ও যুদ্ধের অঙ্গীকার। লক্ষণীয়, দ্বিতীয় অঙ্গীকারে একটি প্রতিরক্ষামূলক সুরক্ষার কথা বলা হয়েছে, কোনো আক্রমণাত্মক যুদ্ধ নয় ।
শয়তানের চিৎকার | মদিনায় প্রাথমিক পর্যায়ে হিজরত | মহানবী হযরত মুহাম্মদ ( সাঃ ) জীবন
শয়তানের চিৎকার
ইবনে হিশামে বর্ণিত আছে, আকাবার অঙ্গীকারের সময় মিনার উপত্যকা থেকে একটি উচ্চস্বরের আওয়াজ ভেসে আসে। যা শোনা গেল তা হলো: “হে তাঁবুতে ঘুমিয়ে থাকা লোকেরা (অর্থাৎ হজে আগতরা), তোমরা কি জান না যে, তোমাদের মধ্য থেকেই একটি বিদ্রোহী দল তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য ‘সাবিদের সঙ্গে মিলিত হয়েছে?” উল্লেখ্য, জাহেলি আরবরা ‘সাবি’ বলতে সেই ব্যক্তিকে বুঝত যে তার পূর্বপুরুষদের ধর্ম (অর্থাৎ পৌত্তলিকতা) ত্যাগ করে একেশ্বরবাদী হয়েছে।
[আনুষঙ্গিক বিষয়: পবিত্র কোরানে ‘সাবিউন’ শব্দটির অর্থ অন্যরকম। কোরান [৫:৬৯] অনুসারে সাবিউন খ্রিষ্টান ধর্মেরও আগের একটি জনগোষ্ঠী। তারা দাবি করত, তাদের কাছে আদমের (আ) পুত্র সিথ-এর কাছ থেকে পাওয়া ধর্মগ্রন্থ আছে। এখনও এই গোষ্ঠীর অস্তিত্ব আছে, যদিও তাদের সংখ্যা খুব কম, আনুমানিক ৩০ হাজার। তারা শূকরের মাংস খায় না এবং যৌনমিলনের পর গোসল করে। সুতরাং দেখা যাচ্ছে, তাদের এক ধরনের শরিয়া রয়েছে। তারা মূলত ইরাকে বসবাস করত। ইরাক ছিল সভ্যতার কেন্দ্রবিন্দু; নানা ধর্ম, সম্প্রদায় ও সংস্কৃতির মানুষের বসবাসের স্থান। বর্তমানকালে তাদের ‘মাদিয়ূন’ বলা হয়। তারা সবাই ইরাকি ।
শব্দ শুনে নবিজি (সা) বললেন, “এটা আকাবার শয়তানদের নেতা আজাব ইবনে উজায়েবের কন্ঠস্বর। আমি আল্লাহর শপথ করে বলছি, হে আল্লাহর শত্রু, আমি তোমাকে দেখে নেব।” একটা কিছু ঘটতে যাচ্ছে যার মাধ্যমে ইসলাম প্রসারিত হওয়ার সুযোগ পাবে, এই ভাবনায় শয়তান বেশ উৎকণ্ঠিত ছিল। তাই আকাবার অঙ্গীকারের সময় সে তাঁবুর লোকদের উদ্দেশে চিৎকার করে উঠেছিল। নবিজি (সা) শয়তানটির নাম জানতেন। তিনি এও জানতেন যে সে ছিল সেখানকার শয়তানদের নেতা। আমরা এই ঘটনা ও অন্যান্য উৎস থেকে জানতে পারি যে, শয়তানরা পরিত্যক্ত উপত্যকাগুলোতে বাস করে, যেখানে মানুষের যাতায়াত কম।
ইয়াসরিববাসী আনসাররা (সিরাহের আলোচনায় এখন থেকে আমর. ইয়াসরিববাসী মুসলিমদেরকে আনসার বলব।) এই কথা শুনে বললেন, “হে আল্লাহর রসুল! এখনই কি আমাদের আক্রমণ চালানো উচিত নয়? তারা যদি আমাদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে চায়, তাহলে কি আমরাই তাদের ওপর আগাম আক্রমণ চালাতে পারি না? আমরা ৭০ জন শক্তিশালী মানুষ আছি। তা ছাড়া আমাদের সবার তলোয়ার আছে, কিন্তু তাদের কোনো অস্ত্র নেই। আমরা মধ্যরাতে তাদের আক্রমণ করতে পারি, বিরাট বিজয় অর্জন করতে পারি।”
উল্লেখ্য, হজের সময় একটিমাত্র অস্ত্র সঙ্গে রাখা যেতে পারে, এবং তা প্রতিরক্ষার জন্য (যেমন, কোনো প্রাণী আক্রমণ করলে তার বিরুদ্ধে অস্ত্রটি ব্যবহার করা যেতে পারে। তবে তা যুদ্ধের তলোয়ার নয়।) নবিজি (সা) তাঁদের বললেন, “আমাকে এই নির্দেশ দেওয়া হয়নি (অর্থাৎ এইভাবে আক্রান্ত হওয়ার আগে মানুষকে হত্যা করা আমার কাজের ধারার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়)। তারপর আলোচনা দ্রুতই শেষ হয়ে যায়।
ইয়াসরিববাসী যেভাবে এসেছিলেন, ঠিক সেভাবেই নীরবে নিজ নিজ তাঁবুতে ফিরে যান। এই খবরটি দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। পরের দিন সকালে কুরাইশরা প্রত্যেক তাঁবুতে একটি করে প্রতিনিধিদল পাঠাল। তারা জিজ্ঞেস করল, “তোমরা কি মুহাম্মদের (সা) সঙ্গে কোনো বৈঠকের খবর জান? তোমাদের গোত্রের কেউ কি তাঁর সঙ্গে দেখা করেছিল?” তারা যখন খাজরাজের তাঁবুতে গেল, তখন খাজরাজ মুসলিমরা চুপ করে রইল, কিন্তু পৌত্তলিকরা আল্লাহর কসম খেয়ে বলল যে তারা নবিজির (সা) সঙ্গে সাক্ষাৎ করেনি। মুসলিম হিসাবে আমাদের মিথ্যা বলার সুযোগ নেই। সুতরাং খাজরাজ মুসলিমরা নীরব ছিলেন। পৌত্তলিকদের কসমের আড়ালে তাঁদের নীরবতা ঢাকা পড়ে গিয়েছিল। তারপর বিষয়টি নিয়ে আর তেমন কিছু হয়নি।