সাবআতুল আহরুফ – কুরআনের ৭ টি আঞ্চলিক ভাষা

পবিত্র কুরআন ” সাবআতুল আহরুফ ” বা ৭ টি আঞ্চলিক ভাষায় নাজিল হয়েছে। এই তথ্যটি অনেকেই জানেন না। আবার অনেকেই সাবআতুল আহরুফ বা কুরআনের ৭ হারফ (7 dialects) নিয়ে প্রশ্ন তুলে থাকেন এবং অভিযোগ করে থাকেন এটা নাকি কুরআনের বিভিন্ন ভার্সন বা সংস্করণ(নাউযুবিল্লাহ)। অনেক সময়ে খ্রিষ্টান মিশনারী কিংবা নাস্তিক মুক্তমনারা বিভিন্ন জায়গায় প্রাপ্ত প্রাচীন কুরআনের কপির কথা প্রচার করেন যেগুলোতে কিছু শব্দ ও বাক্য বর্তমানে প্রচলিত কুরআনের থেকে কিছুটা ভিন্ন। এভাবে তারা আল কুরআনের সংরক্ষণ ও সঙ্কলনকে প্রশ্নবিদ্ধ করেন, তারা বলতে চান যে কুরআন ঠিকভাবে সংরক্ষিত হয়নি এবং সাহাবীগণ আল কুরআনকে পরিবর্তন করে ফেলেছেন (নাউযুবিল্লাহ)। আসুন এইসব অভিযোগের স্বরূপ সন্ধানে যাওয়া যাক।

হারফ বহুবচনে আহরুফ(ج. أحرف حرف)অর্থ কিনারা, তট, কূলভূমি ইত্যাদি। [১]

যেমন আল্লাহ বলেন,

وَمِنَ ٱلنَّاسِ مَن يَعْبُدُ ٱللَّهَ عَلَىٰ حَرْفٍۢ ۖ

অনুবাদঃ কিছু কিছু মানুষ আছে যারা দ্বিধার(প্রান্তে দাঁড়িয়ে) আল্লাহর ইবাদাত করে। (সূরা হাজ্জ, ২২:১১)

সাত হারফে কুরআন নাযিলের বিষয়টি অনেক হাদিস দ্বারা প্রমানিত।

সাবআতুল আহরুফ – কুরআনের ৭ টি আঞ্চলিক ভাষা

সাবআতুল আহরুফ – কুরআনের ৭ টি আঞ্চলিক ভাষা

রাসূলুল্লাহ্ ﷺ বলেছেন, “জিবরাঈল আলাইহিস সালাম আমাকে একভাবে কুরআন শিক্ষা দিয়েছেন। এরপর আমি তাকে অন্যভাবে পাঠ করার জন্য অনুরোধ করতে লাগলাম এবং পুনঃ পুনঃ অন্যভাবে পাঠ করার জন্য অব্যাহতভাবে অনুরোধ করতে থাকলে তিনি আমার জন্য পাঠ পদ্ধতি বাড়িয়ে যেতে লাগলেন। অবশেষে তিনি সাত হারফে তিলাওয়াত করে সমাপ্ত করলেন।” [সহীহ বুখারী, ফাযায়িলুল কুরআন]

একবার উমার রাদ্বিয়াল্লাহ ‘আনহু হিশাম ইবন হাকীম রাদ্বিয়াল্লাহু ‘আনহুকে সূরা ফুরকান তিলাওয়াত করতে দেখলেন। তিনি তার কিরাত গভীর মনোযোগ সহকারে শুনছিলেন। হিশাম ইবন হাকীম অন্য আঞ্চলিক ভাষায় কিরাত করছিলেন। যা উমারের কিরাতের সাথে মেলে না। এটা দেখে উমার রাদ্বিয়াল্লাহু ‘আনহু বেশ রাগান্বিত হলেন এবং তাকে জোর করে রাসূলুল্লাহ ﷺ এর কাছে নিয়ে গেলেন। রাসূল ﷺ দুজনের কিরাতই শুনলেন এবং তাদের মধ্যে ফয়সালা করে দিলেন। বললেন, কুরআন এরকম সাত উপ (আঞ্চলিক) ভাষায় নাযিল করা হয়েছে। সুতরাং তোমাদের জন্য যা সহজতর, সে পদ্ধতিতেই তোমরা পাঠ কর। [সহীহ বুখারী, ফাযায়িলুল কুরআন]

উম্মাহর উপর সহজ করার জন্যই আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা এ পদ্ধতির অনুমোদন দেন। একটি হাদিসে রাসূল ﷺ বলেন জিবরাঈল আলাইহিস সালাম বলেছেন, আল্লাহ আপনাকে হুকুম করেছেন যে, আপনার উম্মাত সাত হারফে কুরআন পাঠ করবে এবং এর যে কোন হারফ ও ধরন অনুসারে তারা পাঠ করলে তা-ই যথার্থ হবে। [সহীহ মুসলিম]

IslamiaGOLN.com Logo 252x68 px Dark সাবআতুল আহরুফ – কুরআনের ৭ টি আঞ্চলিক ভাষা

সাবআতুল আহরুফ বা এই সাত আহরুফ বা হারফসমূহ দ্বারা উদ্দেশ্য কী?

উলামারা অনেক আগে থেকেই এই সাত হারফ দ্বারা কী উদ্দেশ্য তা নির্ণয় করতে গিয়ে মতভেদ করেছেন। তবে সবচেয়ে বিশুদ্ধ ও নির্ভরযোগ্য মত সম্পর্কে শায়খ সালিহ আল মূনাজ্জিদ বলেন,

أحسن الأقوال مما قيل في معناها أنها سبعة أوجه من القراءة تختلف باللفظ وقد تتفق بالمعنى واٍن اختلفت بالمعنى: فاختلافها من باب التنوع والتغاير لا من باب التضاد والتعارض

“এই বিষয়ে উলামাদের থেকে বর্ণিত সর্বাধিক প্রাধান্যপ্রাপ্ত মত হলো যে এই সাবআতুল আহরুফ কিরাতের সাতটি বিশেষ পদ্ধতি যা শব্দের দিক থেকে আলাদা হলেও অর্থের দিক থেকে এক। আর যদি ও অর্থের দিক থেকে একে অপরের থেকে ভিন্নও হয় , তবে তা বৈচিত্র্যের দিক থেকে সামগ্রিকভাবে একে অপরের বিরোধী নয়” [৩]

আমরা কুরআনের হারফ সাতটির সামান্য পরিচয় জানবো ও এই সম্পর্কিত কিছু উদাহরণ দেখে নেবো।

কুরআনে হারফ সাতভাবে ভিন্ন হতে পারে –

(১) ভিন্ন শব্দে একই অর্থ প্রকাশঃ

সাত হারফের প্রকারভেদের একটি হলো ভিন্ন শব্দ তবে একই অর্থ প্রকাশ করবে। যেমন –

আল্লাহ বলেন,

يَـٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُوٓا۟ إِن جَآءَكُمْ فَاسِقٌۢ بِنَبَإٍۢ فَتَبَيَّنُوٓا۟ أَن تُصِيبُوا۟ قَوْمًۢا بِجَهَـٰلَةٍۢ فَتُصْبِحُوا۟ عَلَىٰ مَا فَعَلْتُمْ نَـٰدِمِينَ

অনুবাদঃ মুমিনগণ! যদি কোন পাপাচারী ব্যক্তি তোমাদের কাছে কোন সংবাদ আনয়ন করে, তবে তোমরা পরীক্ষা করে দেখবে, যাতে অজ্ঞতাবশতঃ তোমরা কোন সম্প্রদায়ের ক্ষতিসাধনে প্রবৃত্ত না হও এবং পরে নিজেদের কৃতকর্মের জন্যে অনুতপ্ত না হও। (সূরা হুজুরাত, ৪৯:৬)

এটি হচ্ছে এই আয়াতের আমাদের পরিচিত কিরাতের ইবারাত(মূল টেক্সট)। উপরে মোটা অক্ষরে আন্ডারলাইন করা শব্দটি হলো ফাতাবাইইয়ানু(فَتَبَيَّنُوٓا) যার অর্থ হলো পরীক্ষা করে দেখবে(ফেলে আমর) । কিন্তু অন্যান্য কিছু কিরাতে এই ফাতাবাইইয়ানু(فَتَبَيَّنُوٓا) শব্দটির স্থলে এসেছে ফাতাছাব্বাতু(فتثبتوإ)।

অর্থাৎ,

পরিচিত কিরাতঃ (إِن جَآءَكُمْ فَاسِقٌۢ بِنَبَإٍۢ فَتَبَيَّنُوٓا۟)

ভিন্ন কিরাতঃ (إِن جَآءَكُمْ فَاسِقٌۢ بِنَبَإٍۢ فتثبتوإ۟)

ফাতাবাইইয়ানু(فَتَبَيَّنُوٓا) ও ফাতাছাব্বাতু(فتثبتوإ) এই দুটি শব্দের অর্থই এক তা হলো পরীক্ষা করে দেখা, প্রতিষ্ঠিত করা ইত্যাদি। এখানে উল্লেখ্য যে, আরবরা নুকতা ব্যবহারে অভ্যস্ত ছিলো না তাই আমরা যদি ফাতাবাইইয়ানু ও ফাতাছাব্বাতু শব্দ দুইটিকে নুকতা ছাড়াই দেখি তবে দুটি শব্দই একই রকম।

(২) শব্দে ও অর্থ উভয়তেই পার্থক্য হওয়াঃ

সাত হারফের মধ্যে ২য় হলো যেখানে শব্দ ও অর্থ উভয়তেই পার্থক্য পরিগনিত হয়। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়-

وَإِذَا رَأَيْتَ ثَمَّ رَأَيْتَ نَعِيمًۭا وَمُلْكًۭا كَبِيرًا

অনুবাদঃ আপনি যখন সেখানে বিশাল নেয়ামতরাজি ও সাম্রাজ্য দেখতে পাবেন। (সূরা ইনসান, ৭৬:২০)

এখানে মুলক(مُلْكً) অর্থ সাম্রাজ্য। তবে কিছু কিছু কিরাতে এসেছে আয়াতের মূলক(مُلْكً) শব্দের পরিবর্তে মালিক(مالك) অর্থাৎ, সম্রাট শব্দ এসেছে। অর্থাৎ,

পরিচিত কিরাত- ( وَإِذَا رَأَيْتَ ثَمَّ رَأَيْتَ نَعِيمًۭا وَمُلْكًۭا كَبِيرًا)

অনুবাদঃ আপনি যখন সেখানে বিশাল নেয়ামতরাজি ও সাম্রাজ্য দেখতে পাবেন।

ভিন্ন কিরাত- (وَإِذَا رَأَيْتَ ثَمَّ رَأَيْتَ نَعِيمًۭا وَمالكا كَبِيرًا)

অনুবাদঃ আপনি যখন সেখানে বিশাল নেয়ামতরাজি ও মহান সম্রাটকে দেখতে পাবেন।

দুটি শব্দ পরিপূর্ণ ভিন্ন অর্থ প্রকাশ করছে। তবে সত্য কথা হলো এতে অর্থের পরিবর্তন মোটেও দোষনীয় নয়। কেননা মুলক বা সাম্রাজ্য দ্বারা জান্নাতকে বুঝানো হচ্ছে আর মালিক দ্বারা আল্লাহকে বুঝানো হচ্ছে। মালিককে দেখা বলতে আল্লাহর দর্শনকে বুঝানো হচ্ছে। দুটি শব্দের অর্থই ইসলামী আকীদার সাথে সামঞ্জস্যশীল। তাই অর্থের ভিন্নতা এখানে মোটেই সমস্যার কারণ নয়।

(৩) শব্দে যোজন-বিয়োজন তবে অর্থের অভিন্নতাঃ

কখনো কখনো শব্দে যোজন বা বিয়োজনের কারণে পার্থক্য ঘটে থাকে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়-

আল্লাহ বলেন,

وَٱلسَّـٰبِقُونَ ٱلْأَوَّلُونَ مِنَ ٱلْمُهَـٰجِرِينَ وَٱلْأَنصَارِ وَٱلَّذِينَ ٱتَّبَعُوهُم بِإِحْسَـٰنٍۢ رَّضِىَ ٱللَّهُ عَنْهُمْ وَرَضُوا۟ عَنْهُ وَأَعَدَّ لَهُمْ جَنَّـٰتٍۢ تَجْرِى تَحْتَهَا ٱلْأَنْهَـٰرُ خَـٰلِدِينَ فِيهَآ أَبَدًۭا ۚ ذَ‌ٰلِكَ ٱلْفَوْزُ ٱلْعَظِيمُ

অনুবাদঃ আর যারা সর্বপ্রথম হিজরতকারী ও আনছারদের মাঝে পুরাতন, এবং যারা তাদের অনুসরণ করেছে, আল্লাহ সে সমস্ত লোকদের প্রতি সন্তুষ্ট হয়েছেন এবং তারাও তাঁর প্রতি সন্তুষ্ট হয়েছে। আর তাদের জন্য প্রস্তুত রেখেছেন কানন-কুঞ্জ, যার তলদেশ দিয়ে প্রবাহিত প্রস্রবণসমূহ। সেখানে তারা থাকবে চিরকাল। এটাই হল মহান কৃতকার্যতা। (সূরা তাওবা, ৯:১০০)

আমরা কুরআনে অন্যান্য অনেক স্থানেই জান্নাতের নদীর বর্ণনায় তাজরী মিন তাহতিহাল আনহার উল্লেখ পাই শুধু এই আয়াতটি ছাড়া যেখানে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা জান্নাতের নদীর বর্ণনায় “তাজরী তাহতিহাল আনহার (تَجْرِى تَحْتَهَا ٱلْأَنْهَـٰرُ) ব্যবহার করেছেন। তবে অন্য কিছু কিরাতে এই স্থলেও তাজরী মিন তাহতিহাল আনহার(تَجْرِى من تَحْتَهَا ٱلْأَنْهَـٰر) এর ব্যবহার লক্ষ কর যায়।

অর্থাৎ,

পরিচিত কিরাতে- (وَأَعَدَّ لَهُمْ جَنَّـٰتٍۢ تَجْرِى تَحْتَهَا ٱلْأَنْهَـٰر)

ভিন্ন কিরাতে- (وَأَعَدَّ لَهُمْ جَنَّـٰتٍۢ تَجْرِى من تَحْتَهَا ٱلْأَنْهَـٰر)

এই দুই কিরাতেই আয়াতের অর্থের সামান্যও পরিবর্তন না ঘটা সত্ত্বেও শুধুমাত্র শব্দের হয় যোজন অথবা বিয়োজন ঘটে থাকে।

(৪) শব্দের আগ-পিছ হয়ে থাকে এবং অর্থ অপরিবর্তিত থাকেঃ

এই ক্ষেত্রে উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে-

(ক) আল্লাহ বলেন,

إِنَّ ٱللَّهَ ٱشْتَرَىٰ مِنَ ٱلْمُؤْمِنِينَ أَنفُسَهُمْ وَأَمْوَ‌ٰلَهُم بِأَنَّ لَهُمُ ٱلْجَنَّةَ ۚ يُقَـٰتِلُونَ فِى سَبِيلِ ٱللَّهِ فَيَقْتُلُونَ وَيُقْتَلُونَ ۖ وَعْدًا عَلَيْهِ حَقًّۭا فِى ٱلتَّوْرَىٰةِ وَٱلْإِنجِيلِ وَٱلْقُرْءَانِ ۚ وَمَنْ أَوْفَىٰ بِعَهْدِهِۦ مِنَ ٱللَّهِ ۚ فَٱسْتَبْشِرُوا۟ بِبَيْعِكُمُ ٱلَّذِى بَايَعْتُم بِهِۦ ۚ وَذَ‌ٰلِكَ هُوَ ٱلْفَوْزُ ٱلْعَظِيمُ

অনুবাদঃ আল্লাহ মুসলিমদের থেকে তাদের জান ও মাল এই মূল্যে ক্রয় করে নিয়েছেন যে, তাদের জন্য রয়েছে জান্নাত। তারা যুদ্ধ করে আল্লাহর রাহেঃ অতঃপর মারে ও মরে। তাওরাত, ইঞ্জিল ও কোরআনে তিনি এ সত্য প্রতিশ্রুতিতে অবিচল। আর আল্লাহর চেয়ে প্রতিশ্রুতি রক্ষায় কে অধিক? সুতরাং তোমরা আনন্দিত হও সে লেন-দেনের উপর, যা তোমরা করছ তাঁর সাথে। আর এ হল মহান সাফল্য। (সূরা তাওবা, ৯:১১১)

এখানে মোটা অক্ষরে ও আন্ডারলাইন করা দুটি শব্দ দেখতে পাচ্ছি যা হলো ফাইয়াকতুলুনা ওয়া ইয়ুকতালুন(فَيَقْتُلُونَ وَيُقْتَلُونَ )অর্থাত, তারা মারে ও মরে। তবে অন্য কিছু কিরাতে এই দুটি শব্দ আগে-পিছে হয়েছে। অর্থাৎ, ফাইয়ুকতালুনা ওয়া ইয়াকতুলুন [তারা মরে ও মারে]।

অর্থাৎ,

পরিচিত কিরাত- (يُقَـٰتِلُونَ فِى سَبِيلِ ٱللَّهِ فَيَقْتُلُونَ وَيُقْتَلُونَ )

ভিন্ন কিরাতে- (يُقَـٰتِلُونَ فِى سَبِيلِ ٱللَّه فيقتلونِ فيقتلون)

IslamiaGOLN.com Logo 512x512 1 সাবআতুল আহরুফ – কুরআনের ৭ টি আঞ্চলিক ভাষা

(৫) ইরাবে মতপার্থক্য ও অর্থে অভিন্নতাঃ

ইরাব বলতে আরবী শব্দের শেষের হারাকাত নির্ণয়ের পদ্ধতিকে বোঝায়। ইরাব তিন প্রকার যথা মারফু, মানসুব ও মাজরুর। এর উদাহরণ নিম্নরুপ-

আল্লাহ বলেন,

ٱللَّهِ ٱلَّذِى لَهُۥ مَا فِى ٱلسَّمَـٰوَ‌ٰتِ وَمَا فِى ٱلْأَرْضِ ۗ وَوَيْلٌۭ لِّلْكَـٰفِرِينَ مِنْ عَذَابٍۢ شَدِيدٍ

অনুবাদঃ তিনি আল্লাহ; যিনি নভোমণ্ডল ও ভূ-মণ্ডলের সবকিছুর মালিক। কাফেরদের জন্যে বিপদ রয়েছে, কঠোর আযাব। (সূরা ইবরাহীম, ১৪:২)

আন্ডারলাইন করা অংশটি আল্লাহি(ٱللَّهِ)। ‘আল্লাহ’ শব্দটির সঙ্গে ছোট হা এর নিচে কাসরাহ বা যের হয়ে আল্লাহি হয়েছে অর্থাৎ, এই শব্দটি মাজরুর অবস্থায় আছে। তবে কিছু কিছু কিরাতে এখানে আল্লাহি(ٱللَّهِ) এর স্থলে দাম্মাহ (পেশ) দ্বারা মারফু ভাবে আল্লাহু(ٱللَّهُ) ব্যবহ্রত হয়েছে।

অর্থাৎ,

পরিচিত কিরাতে- (ٱللَّهِ ٱلَّذِى لَهُۥ مَا فِى ٱلسَّمَـٰوَ‌ٰتِ وَمَا فِى ٱلْأَرْضِ)

ভিন্ন কিরাতে- (ٱللَّهُ ٱلَّذِى لَهُۥ مَا فِى ٱلسَّمَـٰوَ‌ٰتِ وَمَا فِى ٱلْأَرْضِ)

অর্থে কোনো ভিন্নতা হয়নি।

(৬) ওয়াকফে মতপার্থক্যঃ

ওয়াকফ বলতে কুরআনের বিভিন্ন স্থানে থামার নির্দেশকে বোঝায়। বিভিন্ন কিরাতে এই ওয়াকফে মতপার্থক্য হয়েছে। যেমন,

আল্লাহ বলেন,

قَالَ لَا تَثْرِيبَ عَلَيْكُمُ ٱلْيَوْمَ ۖ يَغْفِرُ ٱللَّهُ لَكُمْ ۖ وَهُوَ أَرْحَمُ ٱلرَّ‌ٰحِمِينَ

অনুবাদঃ বললেন, আজ তোমাদের বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ নেই। আল্লাহ তোমাদের কে ক্ষমা করুন। তিনি সব মেহেরবানদের চাইতে অধিক মেহেরবান। (সূরা ইউসুফ, ১২:৯২)

এই আয়াতে আমাদের পরিচিত কিরাতে ওয়াকফ হবে (قَالَ لَا تَثْرِيبَ عَلَيْكُمُ ٱلْيَوْمَ ) এর পরে। তবে কিছু কিরায়তে ওয়াকফ করা হয়েছে (قَالَ لَا تَثْرِيبَ عَلَيْكُمُ) এর পরে।

অর্থাৎ,

পরিচিত কিরাতে- (قَالَ لَا تَثْرِيبَ عَلَيْكُمُ ٱلْيَوْمَ ۖ يَغْفِرُ ٱللَّهُ لَكُمْ )

ভিন্ন কিরাতে- (قَالَ لَا تَثْرِيبَ عَلَيْكُمُ؛ۖ ٱلْيَوْمَ يَغْفِرُ ٱللَّهُ لَكُمْ ۖ )

এখানে দেখা যাচ্ছে যে, আলাইকুম(عَلَيْكُمُ) শব্দটির পরে ওয়াকফ হয়েছে আর আলইয়াওমা(ٱلْيَوْمَ ) শব্দটি পরের আয়াতের শুরুতে যোগ হয়েছে। তখন এর অর্থ একটু ভিন্ন হবে পূর্বেরকার অর্থ থেকে। আর তা হলো-

“তোমাদের উপর (পূর্বের আল ইয়াওমা কথাটি না থাকায় “আজ”” হবেনা) কোনো অভিযোগ নেই, আজ(পূর্বের অনুবাদে “আজ” শব্দটি ছিলো না) আল্লাহ তোমাদেরকে ক্ষমা করে দিন।”

(৭) উচ্চারণে পার্থক্যঃ

যেমন,

وَقَالَ ٱرْكَبُوا۟ فِيهَا بِسْمِ ٱللَّهِ مَجْر۪ىٰهَا وَمُرْسَىٰهَآ ۚ إِنَّ رَبِّى لَغَفُورٌۭ رَّحِيمٌۭ

অনুবাদঃ আর সে [নুহ(আ)] বলল, ‘তোমরা এতে আরোহণ কর। এর চলা ও থামা হবে আল্লাহর নামে। নিশ্চয় আমার রব অতি ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।

(সুরা হুদ ১১:৪১)

এই আয়াতে আন্ডারলাইনকৃত মাজরাহা(مَجْر۪ىٰهَا) শব্দকে আরবীতে অনেকে ‘মাজরেহা’ ও উচ্চারণ করে থাকেন। এমনি ভাবে আরবী হরফ ‘সিন’(س) ও সোয়াদ(ص) এর উচ্চারণে আরবদের মাঝে পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। এ ধরনের উচ্চারণগত পার্থক্যের কারণে অর্থের কোনোই পরিবর্তন সাধিত হয়না।

এখানে একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ মূলনীতি মনে রাখতে হবে যে, এই সাত ধরনের হারফের কিরাত সবগুলোই রাসুলুল্লাহ(ﷺ) এর অনুমোদিত ও তাঁর থেকে মুতাওয়াতির বর্ণনা দ্বারা প্রমানিত।

এর প্রমান নিম্নের হাদিসটি থেকে পাই-

উমর ইব্ন খাত্তাব (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি হিশাম ইব্ন হাকীম (রা) কে রাসূলুল্লাহ(ﷺ) এর জীবদ্দশায় সূরা ফুরকান তিলাওয়াত করতে শুনেছি এবং গভীর মনোযোগ সহকারে আমি তার কিরাত শুনেছি। তিনি বিভিন্নভাবে কিরাত পাঠ করেছেন; অথচ রাসূলুল্লাহ্(ﷺ) আমাকে এভাবে শিক্ষা দেননি। এ কারণে সালাতের মাঝে আমি তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য উদ্যত হয়ে পড়েছিলাম, কিন্তু বড় কষ্টে নিজেকে সামলে নিলাম। তারপর সে সালাম ফিরালে আমি চাদর দিয়ে তার গলা পেঁচিয়ে ধরলাম এবং জিজ্ঞেস করলাম,তোমাকে এ সূরা যে ভাবে পাঠ করতে শুনলাম, এভাবে তোমাকে কে শিক্ষা দিয়েছে? সে বলল, রাসূলুল্লাহ(ﷺ) -ই আমাকে এভাবে শিক্ষা দিয়েছেন। আমি বললাম, তুমি মিথ্যা বলছ। কারণ, তুমি যে পদ্ধতিতে পাঠ করেছ, এর থেকে ভিন্ন পদ্ধতিতে রাসূলুল্লাহ্(ﷺ) আমাকে শিক্ষা দিয়েছেন।

এরপর আমি তাকে জোর করে টেনে রাসূলুল্লাহ্(ﷺ) এর কাছে নিয়ে গেলাম এবং বললাম, আপনি আমাকে সূরা ফুরকান যে পদ্ধতিতে পাঠ করতে শিখিয়েছেন এ লোককে আমি এর থেকে ভিন্ন পদ্ধতিতে তা পাঠ করতে শুনেছি। এ কথা শুনে রাসূলুল্লাহ্(ﷺ) বললেন, তাকে ছেড়ে দাও। হিশাম, তুমি পাঠ করে শোনাও। তারপর সে সেভাবেই পাঠ করে শোনাল, যেভাবে আমি তাকে পাঠ করতে শুনেছি। তখন আল্লাহর রাসূল বললেন, এভাবেই নাযিল করা হয়েছে। এরপর বললেন, হে উমর! তুমিও পড়। সুতরাং আমাকে তিনি যেভাবে শিক্ষা দিয়েছেন, সেভাবেই আমি পাঠ করলাম। এবারও রাসূলুল্লাহ্(ﷺ) বললেন, এভাবেও কুরআন নাযিল করা হয়েছে। এ কুরআন সাত উপ (আঞ্চলিক) ভাষায় নাযিল করা হয়েছে। সুতরাং তোমাদের জন্য যা সহজতর, সে পদ্ধতিতেই তোমরা পাঠ কর। [৪]

এ রকমটা করা হয়েছে উম্মাতের জন্যে সহজীকরণের জন্যেই। নিম্নের বর্ণনা দুটিতে এই বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে যায়।

উবাই ইবন কা’ব (রা-) থেকে বর্ণিত।

তিনি বলেন, আমি মসজিদে ছিলাম। এক ব্যক্তি প্রবেশ করে সালাত আদায় করতে লাগল। সে এমন এক ধরলের কিরাত করতে লাগল আমার কাছে অভিনব মনে হল। পরে আর একজন প্রবেশ করে তার পূর্ববর্তী ব্যক্তি হতে ভিন্ন ধরনের কিরা-আত করতে লাগল। সালাত শেষে আমরা সবাই রাসুলুল্লাহ (ﷺ) এর কাছে গেলাম । আমি বললাম, এ ব্যক্তি এমন কিরাত করেছে যা আমার কাছে অভিনব ঠেকেছে এবং অন্যজন প্রবেশ করে তার পূর্ববর্তী জন হতে ভিন্ন কিরাত পাঠ করেছে। তখন রাসুলুল্লাহ (ﷺ) তাদের উভয়কে (কিরাত পাঠ করতে) নির্দেশ দিলেন। তারা উভয়েই কিরাত পাঠ করল। নবী (ﷺ) তাদের দু-জনের (কিরাতের) ধরনকে সুন্দর বললেন।

ফলে আমার মনে নবী (ﷺ) এর কুরআনের প্রতি মিথ্যা অবিশ্বাস ও সন্দেহের উন্মোষ দেখা দিল। এমন কি জাহিলী যুগেও আমার এমন খটকা জাগেনি। আমার ভেতরে সৃষ্ট খটকা অবলোকন করে রাসুলুল্লাহ (ﷺ) আমার বুকে সজোরে আঘাত করলেন। ফলে আমি ঘর্মাক্ত হয়ে গেলাম এবং যেন আমি ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে মহা মহীয়ান আল্লাহর দিকে দেখছিলাম। নবী (ﷺ) আমাকে বললেন-,

ওহে উবাই! আমার কাছে (জিবরাঈল (আঃ)-কে প্রেরণ করা হয়েছে যে, আমি যেন কুরআন এক হরফে তিলাওয়াত করি। আমি তখন তাঁর কাছে পুনরায় অনুরোধ করলাম আমার উম্মাতের জন্য সহজ করুন। দ্বিতীয়বার আমাকে বলা হল যে, দুই হরফে তা তিলাওয়াত করবে। তখন তাঁর কাছে আবার অনুরোধ করলাম, আমার উম্মাতের জন্য সহজ করে দিতে। তৃতীয়বার আমাকে বলা হল যে সাত হরফে তা তিলাওয়াত করবে এবং যত বার আপনাকে জবাব দিয়েছি তার প্রতিটির বদলে আপনার জন্য একটি সাওয়াল! আমার উম্মাতকে ক্ষমা করুন। হে আল্লাহ! আমার উম্মাতকে ক্ষমা করুন। আর তৃতীয় প্রার্থনাটি বিলম্বিত করে রেখিছি সে দিনের জন্য যে দিন সারা সৃষ্টি এমন কি ইবরাহীম (আঃ) ও আমার প্রতি আকৃষ্ট হবেন। [৫]

উবাই ইবন কা’ব (রা-) থেকে বর্ণিত যে নবী (ﷺ) বনূ গিফারের জলাভূমি (ডোবা)-র কাছে ছিলেন। উবাই (রা-) বলেন, তখন জিবরাঈল (আঃ) তাঁর নিকটে এসে বললেন, আল্লাহ আপনাকে আদেশ করেছেন যে আপনার উম্মাত এক ধরনের কুরআন পাঠ করবে । তখন নবী (ﷺ) বললেন, আমি আল্লাহর কাছে তার মার্জনা ও ক্ষমা প্রার্থনা করছি । আমার উম্মাততো এ হুকুম পালনে সমর্থ হবে না । পরে জিবরাঈল (আঃ) দ্বিতীয়বার তার কাছে আগমন করে বললেন, আল্লাহ আপনাকে হুকুম করেছেন যে, আপনার উম্মাত দু’ধরনের কুরআন পাঠ করবে ।

নবী (ﷺ) বললেন, আমি আল্লাহর সকাশে তার মার্জনা ও ক্ষমা প্রার্থনা করছি আমার উম্মাততো তা পালনে সমর্থ হবে না । তারপর তিনি তাঁর কাছে তৃতীয়বার এসে বললেন, আল্লাহ আপনাকে হুকুম করেছেন যে, আপনার উম্মাত তিন হরফে কুরআন পাঠ করবে । নবী (ﷺ) বললেন, আমি আল্লাহর সমীপে তাঁর মার্জনা ও ক্ষমা প্রার্থনা করছি, আমার উম্মাত তো এটি পালনের সমর্থ রাখে না । তারপর জিবরাঈল (আঃ) চতূর্থ বার নবী (ﷺ) -এর কাছে এসে বললেন, আল্লাহ আপনাকে হুকুম করেছেন যে, আপনার উম্মাত সাত হারফে কুরআন পাঠ করবে এবং এর যে কোন হারফ ও ধরন অনুসারে তারা পাঠ করলে তা-ই যথার্থ হবে। [৬]

আর এই কিরাতগুলো আমরা বিভিন্ন ইমামদের নামে চিনে থাকলে ও এর মূল সূত্র রাসুলুল্লাহ(ﷺ) পর্যন্ত পৌছে। উল্লেখ্য যে, স্বল্পসংখ্যক রাবী দ্বারা বর্ণনাকৃত(মুতাওয়াতির নয় এমন), কোনো অপরিচিত(গাইরি মাশহুর), মুনকাতি(বিচ্ছিন্ন) সনদে বর্ণিত, মাওদ্বু(জাল-বানোয়াট) সনদে বর্ণিত ও শায(বিরল) ধরনের কিরাত গ্রহনযোগ্য নয়। কিরাতের বিখ্যাত ইমামদের নাম নিম্নরুপঃ-

১। নাফিঈ ইবনু নুয়াইম(মৃ ১৬৯হি)

২। আসিম বিন নুজুদ(মৃ ১২৭হি)

৩। হামযাহ বিন হাবিব আল কুফি(মৃ ১৫৬হি)

৪। ইবনু আমির(মৃ ১১৮হি)

৫। আবুল হাসান কিসাঈ(মৃ ১৮৯হি)

৬। ইবনু কাছির (মৃ ১২০হি)

৭। আবু আমর ইবনু আলা(মৃ ১৫৪হি)

➫ সম্ভাব্য প্রশ্নঃ-

○ এক: কুরআন যদি সাত হারফেই হয়ে থাকে তাহলে লাওহে মাহফুজে কোন হারফের কুরআন সংরক্ষিত আছে?

উত্তরঃ এর জবাব হাদিসেই আছে। রাসূলুল্লাহ্(ﷺ) বলেছেন, জিবরাঈল (আ) আমাকে একভাবে কুরআন শিক্ষা দিয়েছেন। পরবর্তীতে রাসুলুল্লাহ(ﷺ) মানুষের সুবিধার জন্যে জিবরাঈল(আ) এর কাছে অন্যান্য হারফে শিখাতে অনুরোধ করেছেন তারপর জিবরাঈল(আ) সাত হারফে কুরআন শেখান।
অর্থাৎ, কুরআন প্রথমে যেভাবে নাযিল হয়েছিলো সেই কুরআনই লাওহে মাহফুজে সংরক্ষন করা আছে। আল্লাহু আ’লাম।

○ দুই: কুরআন সংরক্ষনের দায়িত্ব তো আল্লাহই নিয়েছেন তাহলে এই কুরআন নিয়ে এত মতপার্থক্য কেন হবে?

উত্তরঃ এগুলো মোটেই কোনো মতপার্থক্য নয়। এতে কুরআনের চিরন্তন সত্যে একটুও ফাঁটল ধরেছে না। আর পূর্বেই পরিষ্কার করা হয়েছে যে এই ‘মতপার্থক্যে’র ধরন কেমন।

এ সম্পর্কে আরো জানুন:

 

আরও পড়তে পারেন:

Leave a Comment