আবদুল মুত্তালিব: আবরাহা ও হাতির আক্রমণের কাহিনি | বংশানুক্রম এবং হাতির বছর | মহানবী হযরত মুহাম্মদ সাঃ জীবন

আবদুল মুত্তালিব: আবরাহা ও হাতির আক্রমণের কাহিনি | বংশানুক্রম এবং হাতির বছর, এখন আসা যাক আবরাহার কাহিনিতে। আবরাহা ছিলেন আবিসিনিয়ার সম্রাট নাজাশির অধীনে ইয়েমেনের গভর্নর। ইনি কিন্তু সেই নাজাশি নন যাঁর কাছে পরবর্তীকালে কিছু সাহাবি হিজরত করেছিলেন। ইনি তাঁর পিতা। নাজাশি এক সময় ইয়েমেনের কিছু অঞ্চল জয় করে সেখানে আবরাহাকে গভর্নর হিসেবে নিয়োগ দেন। আবরাহা লক্ষ করলেন, প্রতি বছর তাঁর দেশের কিছু মানুষ উত্তর দিকে যায়।

 

 

আবদুল মুত্তালিব: আবরাহা ও হাতির আক্রমণের কাহিনি | বংশানুক্রম এবং হাতির বছর | মহানবী হযরত মুহাম্মদ সাঃ জীবন

 

আবদুল মুত্তালিব: আবরাহা ও হাতির আক্রমণের কাহিনি | বংশানুক্রম এবং হাতির বছর | মহানবী হযরত মুহাম্মদ সাঃ জীবন

তিনি লোকজনকে জিজ্ঞেস করে জানতে পারলেন, তারা হজ করতে সেখানে যায়। তিনি আরও জানতে চাইলেন, “কেন যায়? কী আছে সেখানে?” লোকেরা জবাব দিল, “সেখানে আছে আল্লাহর ঘর।” আবরাহা বললেন, “আমিও একটা ঘর বানাব যা হবে যে কোনো ঘরের চেয়ে সুন্দর। এরপর থেকে তোমরা সবাই এখানে হজ করতে আসবে।” যেই বলা, সেই কাজ। আবরাহা কাচের তৈরি বিশাল অট্টালিকাসম এক ক্যাথেড্রাল তৈরি করলেন যা ছিল পুরো আরব উপদ্বীপে খ্রিষ্টান ধর্মের অনুসারীদের জন্য সবচেয়ে বড় টেম্পল। তিনি ঘোষণা দিলেন, “এখন থেকে তোমাদের সবাইকে উত্তর দিকে মক্কায় কাবাঘরে না গিয়ে এখানে আসতে হবে।”

ক্যাস্ট্রোলটির কথা শুনে মক্কার দিক থেকে একজন বেদুইন ইয়েমেনে গেল। কিন্তু সে আবরাহার তৈরি ক্যাথেড্রালটিকে সম্মান করার জন্য সেখানে যায়নি। বরং সে অপমান করার জন্য সেখানে মলমূত্র ত্যাগ করে রেখে আসে। এতে আবরাহা চরম ক্ষিপ্ত হয়ে প্রতিশোধ হিসেবে কাবাঘর ধ্বংস করার সিদ্ধান্ত নেন, যাতে লোকরা তাঁর তৈরি করা ঘরে আসতে বাধ্য হয়। সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের জন্য তিনি তাঁর সেনাবাহিনীকে প্রস্তুত করলেন।

আবরাহা যখন কাবাঘর আক্রমণের জন্য যাত্রা করেন তখন তাঁর সেনাবাহিনীর সঙ্গে অনেকগুলো (কারও মতে ৮টি, কারও কারও মতে ২০টি) হাতি ছিল। সেগুলোর মধ্যে প্রধান হাতিটির নাম ছিল ‘মাহমুদ’। জানা যায়, মক্কার উপকণ্ঠ থেকে কাবাঘরের পথ দেখিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য আবরাহা আবু রুমাল নামের এক আরব গাইডকে ভাড়া করেন। (পরবর্তীকালে আবু রুমাল এতটাই কুখ্যাতি অর্জন করেছিল যে, কেউ বিশ্বাসঘাতকতা করলে লোকেরা বলত, “তুমি তো আবু রুঘালের চেয়েও বড় বিশ্বাসঘাতক!”)। আবরাহা তাঁর পুরো বাহিনী নিয়ে মক্কায় পৌঁছে প্রথমেই আবদুল মুত্তালিবের ২০০টি উট ও ভেড়া জোর করে ধরে নিয়ে যান। আবদুল-মুত্তালিব সেই সময় ছিলেন মক্কার সর্দার এবং প্রচুর ধনসম্পদের মালিক।

 

https://news.google.com/publications/CAAqBwgKMMS3tgsw0dLNAw?hl=en-US&gl=US&ceid=US:en
আমাদের গুগল নিউজে ফলো করুন

 

তিনি ছিলেন সাধারণ আরবদের তুলনায় একটু বেশি লম্বা (সম্ভবত ছয় ফুট উচ্চতার) এবং সুদর্শন। তাঁকে দেখতেও একজন নেতার মতোই লাগত। জানা যায়, তাবুতে প্রবেশ করার সময় আবরাহা আবদুল-মুত্তালিবের দীর্ঘাকৃতি ও সুন্দর অবয়ব দেখে মুগ্ধনয়নে চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ান এবং শ্রদ্ধার নিদর্শনস্বরূপ আবদুল মুত্তালিবের সঙ্গে মেঝেতে বসে পড়েন। বৈঠকে বসে শুরুতেই আবরাহা আবদুল-মুত্তালিবকে বললেন, “আপনার সঙ্গে আমার কোনো সমস্যা নেই; আপনার লোকদের সঙ্গেও আমার কোনো সমস্যা নেই। আমি কেবল আপনাদের উপাসনাস্থল কাবাঘরকে ধ্বংস করতে চাই। আপনারা সবাই শহর ছেড়ে চলে যাবেন।” আবদুল-মুত্তালিব জবাবে বললেন, “আমি আপনার কাছে কাবাঘর নিয়ে কথা বলতে আসিনি। আমি আমার উটগুলো নিয়ে কথা বলতে এসেছি।”

একথা শুনে আবদুল-মুত্তালিবের প্রতি আবরাহার সব শ্রদ্ধা নিমেষেই উবে গেল: আবরাহা বললেন, “আমি আপনাদের পবিত্র ঘর ধ্বংস করতে এসেছি, আর আপনি আপনার উট নিয়ে কথা বলতে এসেছেন!” আবদুল মুত্তালিব খুব কৌশলে এই কথার জবাব দিলেন, “পবিত্র ঘরের একজন মালিক আছেন, তিনিই সেটি রক্ষা করবেন। সেই কাজ আমার নয়। কিন্তু উটগুলোরও একজন মালিক আছে এবং সে হচ্ছে আমি। তাই মালিক হিসেবে আমার কাজ হচ্ছে উটগুলোকে রক্ষা করা। আবদুল-মুত্তালিবের ওই চাতুর্যপূর্ণ কথার যথাযথ উত্তর নিতে না পেরে আবরাহা তাঁকে উটগুলো ফিরিয়ে দেন। আবদুল মুত্তালিবকে উট ফিরিয়ে দিলেও আবরাহা কাবাঘর ধ্বংস করার পরিকল্পনায় তখনও অবিচল। উপায়ান্তর না দেখে কুরাইশরা শহর ত্যাগ করে পাহাড়ের দিকে চলে যায়।

 

আবদুল মুত্তালিব: আবরাহা ও হাতির আক্রমণের কাহিনি | বংশানুক্রম এবং হাতির বছর | মহানবী হযরত মুহাম্মদ সাঃ জীবন

 

যাওয়ার আগে কাবাঘরের নিরাপত্তার জন্য তারা অনেক প্রার্থনা করে। আবদুল মুত্তালিব কাবার সামনে দাঁড়িয়ে আর্জি জানান, “হে আল্লাহ। এই বিশাল বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার সামর্থ্য আমাদের নেই। তাদের হাতি আছে, আছে হাজার হাজার সৈন্য। তারা আমাদের চেয়ে অনেক বেশি। শক্তিশালী। আপনি এই ঘর রক্ষার দায়িত্ব গ্রহণ করুন।” কুরাইশরা শহর ছেড়ে চলে যাওয়ার পর আবরাহার বাহিনী কাবাঘর আক্রমণের জন্য প্রস্তুতি নিতে থাকে। প্রধান হাতি মাহমুদকে আদেশ করা হলো। এগিয়ে যাওয়ার জন্য। কিন্তু মাহমুদ তো নড়ছে না! তাকে বেত্রাঘাত করে রক্তাক্ত করে ফেললেও সে নড়াচড়ার লক্ষণ দেখাল না। আল্লাহ এভাবেই হাতিটিকে কাবাঘরে প্রবেশ করা থেকে বিরত রাখলেন।

এ অবস্থায় কী করা যায় তা নিয়ে আবরাহার বাহিনী যখন নিজেদের মধ্যে আলোচনা করছে, ঠিক তখনই আকাশে ঝাঁকে ঝাঁকে পাখি এসে তাদের ওপর পাথর নিক্ষেপ করতে শুরু করে। এ যেন জাহান্নাম থেকে আসা পাথর! আবরাহার বাহিনীর মানুষ বা প্রাণী যে-ই হোক না কেন, পাথরগুলোর আঘাত লাগা মাত্রই আক্ষরিক অর্থেই ধ্বংস হয়ে পলিত মাংসের স্তূপে পরিণত হচ্ছিল। কুরাইশদের চোখের সামনেই এই আশ্চর্যজনক ঘটনাটি ঘটে। জানা যায়, আবরাহা নিজেই সবচেয়ে খারাপ পরিণতি ভোগ করেছিলেন। তাঁর লোকজন তাঁকে ফিরিয়ে নিয়ে গেলেও তাঁর ত্বক গলে যায় এবং তিনি ইয়েমেনে নিজের বাড়িতে পৌঁছার আগেই মারা যান। পথিমধ্যেই তাঁকে সমাহিত করা হয়। উল্লেখ আছে যে, নবি করিমের (সা) জন্মের সময়ও মক্কায় আবরাহা বাহিনীর হাতির চিহ্ন ছিল।

সুনান আল তিরমিজির বর্ণনা অনুসারে, কুবাস ইবনে আশাম (যিনি নবিজির (সা) চেয়ে বয়সে বড় ছিলেন) নামের এক সাহাবি প্রথম উমাইয়া খলিফার জিজ্ঞাসার উত্তরে বলেছিলেন, “আমার মনে আছে আমার মা আমাকে হাতির বিষ্ঠা দেখিয়েছিলেন, যা তখন শুকিয়ে হলুদ হয়ে গিয়েছিল।” আয়েশা (রা) স্মৃতিচারণ করেন যে, তিনি বাল্যকালে যখন মক্কায় ছিলেন তখন ইয়ামেন থেকে আসা হাতির একজন গাইডকে দেখেছিলেন। লোকটি অন্ধ হয়ে গিয়েছিল এবং ভিক্ষুকের মতো জীবনযাপন করত। স্পষ্টতই আল্লাহর পক্ষ থেকে এটি ছিল এক প্রকারের শাস্তি।

আরো পড়ুনঃ

 

Leave a Comment