পবিত্র মাস | হুদায়বিয়ার সন্ধি (চুক্তি)-১ | মহানবী হযরত মুহাম্মদ ( সাঃ ) জীবন

পবিত্র মাস | হুদায়বিয়ার সন্ধি (চুক্তি)-১, ইতিহাসবিদরা সর্বসম্মতিক্রমে একমত যে, নবি করিম (সা) হিজরির ৬ষ্ঠ বছরের পহেলা জিলকদ মদিনা ত্যাগ করেন। পহেলা জিলকদ তারিখটা কেন গুরুত্বপূর্ণ? কারণ, জিলকদের প্রথম দিন থেকেই পবিত্র মাসের গণনা শুরু হয়। চারটি পবিত্র মাস হলো: জিলকদ, জিলহজ, মহররম এবং রজব। আল্লাহ তায়ালা কোরানে বলেছেন:

“আকাশ ও পৃথিবীর সৃষ্টির দিন থেকেই আল্লাহর বিধানে আল্লাহর কাছে মাসগণনায় মাস বারোটি, তার মধ্যে চারটি মাস হারাম।” [সুরা তওবা, ৯:৩৬] [আনুষঙ্গিক দ্রষ্টব্য: আমরা ৩২তম পর্বে আলোচনা করেছি, কুরাইশরা তাদের সুবিধামতো যখন-তখন পবিত্র মাসগুলোকে অদল-বদল করত। ১০ম হিজরিতে নবিজির (সা) নির্দেশে মাসগুলো সঠিক ক্রমে ফিরে এসেছে।

পবিত্র মাসের শুরু পর্যন্ত অপেক্ষা করার পর নবিজি (সা) মক্কার উদ্দেশে যাত্রা করেন। এর মাধ্যমে তিনি কুরাইশদের কাছে স্পষ্ট বার্তা দিতে চেয়েছেন: “আমার যুদ্ধ করার কোনো ইচ্ছা নেই। আমি শান্তিপূর্ণভাবে মক্কায় যাচ্ছি।” আর এই পবিত্র মাসে প্রত্যেকেই মক্কায় যেতে পারবে, কুরাইশদের তাতে বাধা দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। এই রীতিটি তারা ইব্রাহিমের (আ) সময় থেকেই চালু রেখেছিল [৪র্থ পর্বে বিস্তারিত আছে]।

পবিত্র মাস | হুদায়বিয়ার সন্ধি (চুক্তি)-১ | মহানবী হযরত মুহাম্মদ ( সাঃ ) জীবন

 

পবিত্র মাস | হুদায়বিয়ার সন্ধি (চুক্তি)-১ | মহানবী হযরত মুহাম্মদ ( সাঃ ) জীবন

 

জুল হুলায়ফা উপত্যকায় দুই রাকাত নামাজ

নবি করিম (সা) মদিনার ‘মিকাত’ {১} জুল হুলায়ফা পৌঁছার পর দুই রাকাত নামাজ পড়েন এবং ইহরাম বাঁধেন। মদিনা থেকে মক্কার দিকে যাওয়ার আগে সেখানে দুই রাকাত নামাজ পড়া সুন্নত। নবিজি (সা) এই নামাজটি পড়েছিলেন জুল হুলায়ফা উপত্যকার পবিত্রতার কারণে, ইহরামের কারণে নয় ।

প্রাণীদের প্রস্তুত করা

তারপর নবি করিম (সা) প্রাণীদের প্রস্তুত করতে শুরু করেন। এই রীতিটি ইব্রাহিমের (রা) সময় থেকে প্রচলিত ছিল, যদিও আমাদের সাম্প্রতিক সময়ে এই সুন্নাহর আর অনুশীলন করা হয় না। এক বর্ণনা অনুসারে, নবিজি (সা) ৭০টি উট সঙ্গে নিয়েছিলেন। এখানে প্রাণীদের প্রস্তুত করার অর্থ হলো, তাদের মালা ও বিভিন্ন ধরনের চিহ্ন দিয়ে সাজানো যাতে সবাই বুঝতে পারে এগুলো আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য কুরবানি করা হবে এবং মাংসগুলো মক্কার দরিদ্র জনগণকে বিলিয়ে দেওয়া হবে। তবে একবার প্রস্তুত করা (বা সাজানোর) পর তা বিশেষ কোনো কারণ ছাড়া অন্য কাজে ব্যবহার করা যাবে না। প্রস্তুত করা প্রাণী আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার নিদর্শন। আল্লাহ তাদের বিষয়ে বলেছেন:

“আর কেউ আল্লাহর নিদর্শনগুলোকে সম্মান করলে সে তো তা (করে) হৃদয়ের ধর্মনিষ্ঠা থেকে।” [সুরা হজ, ২২:৩২] উল্লেখ্য, এই রীতিটি আরবের পৌত্তলিকদের কাছেও ধার্মিকতার একটি লক্ষণ ছিল। নবিজি (সা) জুল হুলায়ফায় গিয়ে প্রাণীদের প্রস্তুত করার কাজটি সম্পন্ন করেন।

 

islamiagoln.com google news
আমাদের গুগল নিউজে ফলো করুন

 

স্কাউট পাঠানো

জ্বল হুলায়ফা থেকে নবিজি (সা) বুসর ইবনে সুফিয়ান আল-বুজাই নামের একজন ব্যক্তিকে মক্কায় পাঠান সেখানে কুরাইশরা কী করছে তা আগাম জানার জন্য। তিনি যাকে পাঠান সেই সাহাবি বুসর ইবনে সুফিয়ানকে কেউ চিনত না। তিনি আনসার কিংবা মুহাজির ছিলেন না, ছিলেন খুঁজা গোত্রের, যারা নিরপেক্ষ হিসেবে পরিচিত ছিল। এটি ছিল নবিজির (সা) একটি কৌশল । আরেকটি বিষয় খেয়াল করুন, অন্যান্য অভিযানের ক্ষেত্রে তিনি যেমন উল্টো দিকে রওনা দিয়ে ঘুরে মূল গন্তব্যে যেতেন, হুদায়বিয়ার ক্ষেত্রে তেমনটি করেননি। এ ক্ষেত্রে তিনি বোঝাতে চেয়েছিলেন যে, তাঁর গোপন করার কিছু নেই, শান্তিপূর্ণভাবে ওমরা পালন করা ছাড়া তাঁর আর কোনো উদ্দেশ্য নেই ।

যা-ই হোক, যাত্রাপথে নবিজির (সা) কাছে খবর পৌঁছে যে, সামনে গায়কা নামক স্থানে কিছু লোককে দেখা গেছে। তারা কুরাইশদের কোনো দল হতে পারে ভেবে যাচাই করার জন্য তিনি কিছু সাহাবিকে সেখানে ছোট অভিযানে পাঠান। শেষ পর্যন্ত দেখা গেল যে, আশঙ্কাটি ছিল অমূলক। কিন্তু অভিযান থেকে ফেরার পথে এমন একটি ঘটনা ঘটে, যা ফিকহের দিক থেকেও গুরুত্বপূর্ণ। ঘটনাটি আমরা আলোচনা করছি: ফিকহ বিষয়: যারা ইহরাম অবস্থায় নেই তারা কি ইহরাম অবস্থায় যারা আছে তাদের জন্য শিকার করতে পারে?

ছোট অভিযান থেকে ফেরার পথে সাহাবিরা একটি জেব্রার পাল দেখতে পান। তাঁদের মধ্যে আবু কাতাদা আল-আনসারি ছাড়া বাকি সবাই ইহরাম বাঁধা অবস্থায় ছিলেন। আবু কাতাদা ছিলেন কোরবানির পশুগুলো দেখভালের দায়িত্বে। ইহরাম অবস্থায় শিকার করা নিষিদ্ধ। তাই জেব্রাগুলোকে দেখেও তাঁদের কেউ নড়েননি । তাঁরা আবু কাতাদাকেও জেব্রার কথাটি জানাননি।

 

পবিত্র মাস | হুদায়বিয়ার সন্ধি (চুক্তি)-১ | মহানবী হযরত মুহাম্মদ ( সাঃ ) জীবন

 

কিছুক্ষণ পর আবু কাতাদা নিজেই জেব্রাগুলো দেখতে পান। তাঁর কাছে তখন তিরধনুক ছিল না। তিনি ঘোড়ায় চড়ে ছিলেন, তাই আশেপাশের সাহাবিদের অনুরোধ করেন তার তিরধনুক এগিয়ে দিতে। কিন্তু সাহাবিরা তা না করে বললেন, ‘আমরা ইহরাম অবস্থায় আছি।’ আবু কাতাদা আর দেরি না করে ঘোড়া থেকে লাফ দিয়ে নেমে নিজের তিরধনুক নিয়ে এনে একটি জেব্রা শিকার করতে সক্ষম হন। তিনি সেটি জবাই করে সাহাবিদের মাংস খেতে সাধলে সাহাবিরা বলেন, “আমরা তো এই মাংস খেতে পারি না।”

তাঁরা শিবিরে ফেরার পর নবিজির (সা) কাছে জানতে চান, তাঁদের ওই জেব্রার মাংস খাওয়ার অনুমতি ছিল কি না? 

নবিজি (সা) তাঁদের জিজ্ঞাসা করলেন, “তোমরা কি কেউ তাঁকে (আবু কাতাদাকে) দেখিয়ে দিয়েছ কোথায় জেব্রা ছিল?”

সাহাবিরা: না ।

নবিজি (সা): তোমরা কি কেউ তাকে জেব্রা শিকারে সাহায্য করেছিলে? সাহাবিরা: না । নবিজি (সা): তাহলে তোমরা এটি খেতে পার। আর যদি তোমাদের কাছে অতিরিক্ত মাংস থাকে, তাহলে তা আমার কাছেও নিয়ে এসো।

এই ঘটনা থেকে ফিকহ বিধান হলো: যদি কোনো ইহরামি (ইহরাম অবস্থায় থাকা) ব্যক্তির সঙ্গে কোনো অ-ইহরামি (ইহরাম অবস্থায় না থাকা) ব্যক্তি থাকে এবং অ-ইহরামি ব্যক্তি কোনো পশু শিকার করে সেই পশুর মাংস ইহরামি ব্যক্তিকে খাওয়াতে চায়, তাহলে তার (ইহরামি ব্যক্তির) জন্য এটি খাওয়া হালাল, যদি না ইহরামি ব্যক্তি শিকারে সাহায্য করে। এই ঘটনায় আমরা দেখতে পাই, হারাম কিছু এড়িয়ে চলার বিষয়ে সাহাবিরা কত বেশি সতর্ক থাকতেন।

আরও পড়ুনঃ

Leave a Comment