আয়েশার (রা) ওপর মিথ্যা অপবাদ-২ | মহানবী হযরত মুহাম্মদ ( সাঃ ) জীবন, সিরাহের লেখকরা আয়েশার (রা) সম্পর্কে মিথ্যা অপবাদের বিস্তারিত উল্লেখ না করার আরেকটি কারণ নবিজির (সা) প্রতি ভালোবাসা। নবিজির (সা) স্ত্রীদের অবমাননা করা তো নবিজিকে (সা) অবমাননা করারই নামান্তর। আমরা সুন্নি মুসলিমরা নবিজির (সা) স্ত্রীদেরও ‘আহলুল বাইত’ (নবি-পরিবারের অংশ) বলেই মনে করি। সুতরাং তাঁদের মানমর্যাদা আমাদের কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ; তাঁদের মানহানি বা অপমান আমরা অতি গুরুতর বিষয় হিসেবে বিবেচনা করি। [প্রসঙ্গক্রমে, এই ক্ষেত্রে শিয়াদের সঙ্গে সুন্নিদের মৌলিক পার্থক্য রয়েছে। শিয়াদের সংজ্ঞায় আহলুল বাইত শুধু নবিজির (সা) রক্তের সম্পর্কের আত্মীয়রা; যেমন ফাতেমা, আলি এবং তাঁদের বংশধরগণ ।
আয়েশার (রা) ওপর মিথ্যা অপবাদ-২ | মহানবী হযরত মুহাম্মদ ( সাঃ ) জীবন

আগের পর্বে দেখেছি, আল্লাহ কোরানের আয়াতের (৬৩:১-২) মাধ্যমে আবদুল্লাহ ইবনে উবাইয়ের আসল চেহারা উন্মোচন করেছেন। তাই সে প্রতিশোধের আগুনে জ্বলছিল। সেই সময় সে আয়েশাকে (রা) একজন অবিবাহিত যুবকের সঙ্গে আসতে দেখে গুজব রটানোর সুযোগ পেয়ে যায় এবং সে সেই সুযোগ হাতছাড়া করেনি।
যাত্রাপথের বিষয়টি নিয়ে যে কিছু রটতে পারে এমন কোনো দুর্ভাবনা অসুস্থ আয়েশার (রা) মনে ক্ষণকালের জন্যও উদয় হয়নি। পুরো ঘটনাটি তাঁর কাছে অস্বাভাবিক কিছু বলেও মনে হয়নি। তিনি বলেন, “অসুস্থ থাকার সময়ে কেউ আমাকে জানায়নি যে গুজব দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়েছে। শুধু একটি বিষয়ে আমার কিছুটা সন্দেহ হচ্ছিল, নবিজি (সা) আমার সঙ্গে আর আগের মতো খোলামেলা আচরণ করছিলেন না।”
[নোট ১৪: এই ঘটনা থেকে আমরা আয়েশার (রা) সরলতার পাশাপাশি মানবিক বৈশিষ্ট্যেরও পরিচয় পাই। নবিজির (সা) তো কোনো অদৃশ্যের জ্ঞান ছিল। না। তাই ঘটনার আকস্মিকতায় আর পাঁচজনের মতো তিনিও কিছুটা দ্বিধান্বিত ছিলেন। মুনাফেকদের ছড়ানো গুজবে তিনি কিছুটা বিচলিতও হন। কিন্তু আয়েশা (রা) অসুস্থ থাকায় তিনি এ বিষয়ে তাঁকে কিছু জিজ্ঞেস করেননি।
অবশ্যই তাঁর অন্তর বলছিল যে, আয়েশা (সা) এসব থেকে মুক্ত। নবিজি (সা) আয়েশাকে (রা) অপবাদ থেকে রক্ষা করতে চাচ্ছিলেন। তারপরও তিনি আয়েশার (রা) প্রতি স্বভাবসুলভ কোমল আচরণ করছিলেন না। আয়েশা (রা) বুঝতে পারছিলেন যে কিছু একটা হয়েছে, কিন্তু তা যে এতটা খারাপ পর্যায়ে পৌঁছেছে সে সম্পর্কে তাঁর কোনো ধারণাই ছিল না।
মাসখানেক পর আয়ে’শা (রা) সুস্থ হয়ে ওঠেন। একদিন তিনি উম্মে মিসতাহ বিনতে আবি রুহমের (আবু বকরের (রা) কাজিন) সঙ্গে প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে বাইরে যান। তাঁর ভাষায়, “এটি সেই সময়ের কথা যখন বাড়ির ভেতরে শৌচাগার তৈরির প্রচলন শুরু হয়নি। আমরা ছিলাম আরব।”
[নোট ১৫: আয়ে’শার (রা) ভাষ্য অনুযায়ী, তাঁর জীবদ্দশাতেই সামাজিক রীতিনীতির পরিবর্তন শুরু হয়েছিল। আগে আরবরা বাড়ির ভেতরে শৌচাগার তৈরি করত না, এটি মূলত ছিল অনারবদের রীতি। পানির ব্যবস্থা ছিল না বলে পরিচ্ছন্নতার খাতিরে বাড়ির ভেতরে শৌচাগার রাখা সম্ভব ছিল না। বাড়ির ভেতরে শৌচাগার তৈরির প্রচলন শুরু হয় পরবর্তী সময়ে।] তাঁরা শৌচাগার সেরে ফেরার সময় উম্মে মিসতাহ আয়ে’শাকে (রা) বললেন, “আমার পুত্র মিসতাহকে অভিশাপ দাও।” বোঝাই যাচ্ছে, তিনি তাঁর পুত্রের ওপর প্রচণ্ড রাগান্বিত।
আয়ে’শা (রা) বললেন, “ছি! আপনি নিজের ছেলেকে নিয়ে এটা বলতে পারলেন? সে তো বদরের যুদ্ধে অংশ নিয়েছিল!”
উম্মে মিসতাহ বললেন, “মানুষ কী বলাবলি করছে তার কিছুই কি তুমি জান না?” তখনই আয়ে’শা (রা) তাঁকে নিয়ে রটানো গুজব ও মিথ্যা অপবাদের কথা প্রথমবারের মতো জানতে পারেন। কিছু সিরাহের বইয়ে উল্লেখ আছে, উম্মে মিসতাহের মুখে অপবাদের কথা শুনে তিনি অজ্ঞান হয়ে পড়েছিলেন। আয়ে’শা (রা) মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন, আগের চেয়ে বেশি অসুস্থ হয়ে পড়েন । তিনি বর্ণনা করেছেন, “নবিজি (সা) আমার কাছে এসে আমি কেমন আছি জিজ্ঞেস করলে আমি আমার বাবার বাড়ি যাওয়ার জন্য তাঁর অনুমতি চাই।”
[নোট ১৬: এ থেকে আমরা আয়শার (রা) বিচক্ষণতার পরিচয় পাই। তিনি মানসিক আঘাত পেয়েছিলেন সত্য, কিন্তু আবেগাপ্লুত হয়ে বিচারবুদ্ধি হারাননি। তিনি চেয়েছিলেন প্রথমে বাবার বাড়ি গিয়ে বিষয়টির সত্যতা যাচাই করতে। তিনি তখনও একজন কিশোরী, কিন্তু তাঁর বিবেচনাবোধ ছিল অসাধারণ। এমন অবস্থায়ও তিনি নিজেকে শান্ত রাখতে পেরেছিলেন ।]
নবিজির (সা) অনুমতি পেয়ে আয়ে’শা (রা) বাবার বাড়ি ছুটে যান; মা উম্মে রুমানকে বলেন, “মা, লোকেরা এসব কী বলছে? এসব গুজবের কথা তুমি কেন আমাকে আগে বলনি?”
মা তাঁকে সান্ত্বনা দিয়ে বলেন, “দোহাই তোমার, একটু শান্ত হও। তোমার স্বামীর মতো অন্য কেউ স্ত্রীকে এত ভালোবাসে না। তবে কিছু লোক কিছু কথা বলছে।” [ নোট ১৭: লক্ষ করুন, আয়ে’শার (রা) প্রশ্নের উত্তরে উম্মে রুমান ‘হ্যা’ বা ‘না’ কিছুই বলেননি। কিন্তু মায়ের এমন প্রতিক্রিয়া দেখেই আয়ে’শা (রা) বুঝে নেন, তিনি যা শুনেছেন তা সত্য ।]
আয়ে’শা (রা) শুধু একটি কথাই বললেন, “সুবহানাল্লাহ! আসলেই কি মানুষজন এসব কথা বলছে?”
[নোট ১৮: কী ও কেন রটেছে তা তিনি অনুধাবন করতে পারছিলেন না, কারণ তিনি ছিলেন একান্তই সহজ-সরল একজন কিশোরী। তাঁর বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছিল, মানুষ এতটা খারাপ ও নিষ্ঠুর হতে পারে।]
তিনি বর্ণনা করেছেন, “আমি শুধু কেঁদেই যাচ্ছিলাম। রাত শেষ হয়ে ভোর হয়ে এলেও আমার কান্না থামছিল না। সারারাত আমার চোখে এক ফোঁটা ঘুম আসেনি।” তারপর তিনি সুরা আন-নুরের একটি আয়াতের [২৪:১১] একটি অংশ উল্লেখ করে বলেন, “তাদের মধ্যে অগ্রণী/মূল ভূমিকা নিয়েছিল আবদুল্লাহ ইবনে উবাই ইবনে সালুল এবং খাজরাজ উপজাতির তার কিছু অনুসারী।” [নোট ১৯: তিনি আবদুল্লাহ ইবনে উবাই ইবনে সালুলের নাম উল্লেখ করেছিলেন। এটাকে এই আয়াতের [২৪:১১] তাফসির হিসেবে গ্রহণ করা হয়। আয়ে’শার (রা) বক্তব্যে পরিষ্কার যে সে-ই এই গুজব রটানো শুরু করেছিল।]
[নোট ২০: আবদুল্লাহ ইবনে উবাই খাজরাজ হওয়ার কারণে মুনাফেকদের বেশির ভাগই ছিল খাজরাজ উপজাতির। খাজরাজের কেউ কেউ আবদুল্লাহ ইবনে উবাইকে অনুসরণ করত কারণ সে ছিল তাদের গোত্রের একজন। তা ছাড়া সে ছিল জাহেলি যুগে তাদের নেতা; অন্য সব নেতা বুআতের যুদ্ধে মারা যাওয়ার ফলে জাহেলি যুগের প্রথা অনুসারে গোত্রের লোকেরা তাকে মেনে চলত ।]
আয়ে’শা (রা) আরও বর্ণনা করেছেন, “তিনজন সাহাবিও এই গুজব ছড়ানোতে যোগ দিয়ে ছিল—মিসতাহ (আয়ে’শার দ্বিতীয় কাজিন), হামামানা বিনতে জাহশ এবং হাসান ইবনে সাবিত। “
[নোট ২১: মুনাফেকদের বাইরে কেবল এই তিনজনই গুজব রটানোর সঙ্গে জড়িত ছিল। তারা যদিও নিজেরা মিথ্যা কাহিনি তৈরি করেনি, কিন্তু গল্পগুজবের মাধ্যমে গুজবের ডালপালা বিস্তারে সহায়ক ভূমিকা রেখেছিল যেমন, তারা এই ধরনের কথাবার্তা বলে বেড়িয়েছে: ওরা যা বলছে আপনি কি তা শুনেছেন? কীসব বলাবলি হচ্ছে, আপনি কি জানেন? ইত্যাদি। আমাদের শরিয়ত অপবাদ ছড়ানো কিংবা খোশগল্প করার মাধ্যমে গুজব ছড়ানোকে সমর্থন করে না, বিশেষ করে যেখানে অশ্লীলতা বা মানুষের মানসম্মানের বিষয় জড়িত।
আয়ে’শা (রা) আরও বলেন, “হাম্মানা ছিল জয়নব বিনতে জাহশের (রা) বোন। নবিজির (সা) স্ত্রীদের মধ্যে কেবল জয়নবই ছিলেন আমার প্রতিদ্বন্দ্বী। সে (হাম্মানা) হয়তো তাঁর বোনকে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় এগিয়ে থাকতে সাহায্য করতে চেয়েছিল । কিন্তু ধর্মভীরুতাই জয়নবকে (আমার সম্পর্কে খারাপ কিছু বলা থেকে) বিরত রেখেছে। হাম্মানা কিছু না বুঝে (বোকার মতো) কাজ করেছিল এবং তার ফলও ভোগ করেছিল।”
আয়ে’শার (রা) বর্ণনা অনুসারে, জয়নব নবিজিকে (সা) বলেছিলেন, “হে আল্লাহর রসুল, আমার চোখ ও কানকে আমি পাপের অংশ করব না। আল্লাহর কসম, আমি আয়ে’শা সম্পর্কে শুধু ভালোই জানি।”
[নোট ২২: জানা যায়, আয়ে’শা (রা) আর জয়নবের (রা) মধ্যে এক ধরনের রেষারেষি ছিল; সাধারণত তাঁদের বনিবনা হতো না। আমরা জানি, জয়নব ছিলেন নবিজির (সা) ফুপাতো বোন। তাঁর বেশ কিছু ভালো গুণ ছিল। আয়ে’শা (রা) জানতেন যে, জয়নবের প্রতি নবিজির (রা) বিশেষ টান আছে। তবু তিনি জয়নবের ধর্মভীরুতা স্বীকার করে নিয়েছেন। আয়ে’শার কথার অর্থ দাঁড়ায়, ধর্মভীরুতার কারণেই আল্লাহ জয়নবকে গুজব রটানো থেকে রক্ষা করেছেন।]
আয়েশার (রা) আরও বর্ণনা অনুসারে, নবিজি (সা) পরিবারের অন্য লোকজনের কাছ থেকে ঘটনার ব্যাপারে সাক্ষ্য নেন। তিনি আলি ইবনে আবি তালিব (রা) এবং উসামা ইবনে জায়েদের (রা) বক্তব্য শোনেন। তিনি জানতে চান, তাঁরা অস্বাভাবিক কিছু দেখেছেন কি না। কিন্তু এসব সাক্ষ্য নেওয়ার বিষয়টি আয়েশা (রা) সেই সময়ে জানতেন না ।

[নোট ২৩: আমরা জানি, আলি খাদিজার (রা) বাড়িতেই বড় হয়েছিলেন। তিনি প্রায়ই নবিজির (সা) বাড়িতে আসতেন। আর উসামার জন্ম হয়েছে নবিজির (সা) বাড়িতেই, কারণ তাঁর পিতা জায়েদ ইবনে হারিসা ছিলেন নবিজির (সা) দত্তক নেওয়া পুত্র এবং মা উম্মে আয়মান নবিজিকে (সা) তাঁর ছোটবেলায় দেখভাল করতেন। উসামা অল্পবয়সী ছিলেন বলে নবিজির (সা) স্ত্রীদের ঘরেও হুটহাট ঢুকতে পারতেন।]
উসামার সাক্ষ্য অনুযায়ী নবিজির (সা) স্ত্রীদের সম্পর্কে এমন অভিযোগের কোনো সুযোগ নেই। তাঁর ভাষায়, “এটা একেবারেই সম্ভব নয়। আমি তাঁদের সবাইকেই চিনি। তাঁদের কারও চরিত্রই এমন নয়।” আর আলি (রা) বলেছিলেন, “হে আল্লার রসুল, আল্লাহ আপনাকে কোনো কিছু বেঁধে দেননি। আরও অনেক নারী আছে যাদের থেকে আপনি বেছে নিতে পারেন। তবে যদি আপনি তাঁর (আয়েশার) চরিত্র সম্পর্কে জানতে চান, তবে তাঁর দাসী বারিরাহকে জিজ্ঞেস করুন, সে আমাদের চেয়ে বেশি জানবে।”
[নোট ২৪: এখানে লক্ষণীয়, উসামা খুব স্পষ্টভাবেই আয়েশার (রা) পক্ষে বলেছেন, আর আলির (রা) বক্তব্য ছিল কিছুটা অস্পষ্ট। তিনি বলতে চেয়েছেন, নবিজির মনে (সা) যদি তাঁকে আয়েশাকে (রা) সন্দেহ জাগে, তাহলে তিনি যে নারীকে চান তাকেই বিয়ে করার অনুমতি আল্লাহ তাঁকে দিয়েছেন; তবে আলি (রা) এ ক্ষেত্রে নবিজিকে (সা) আয়েশার দাসী বারিরাহর সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দিয়েছেন।]
[নোট ২৫৷ বারিবাহ ছিলেন আয়েশার (রা) একজন দাসী। আয়েশা (রা) তাঁকে অর্থ দিয়ে কেনেন এবং তারপর তাঁকে মুক্তি দেন। মুক্তি পেয়ে বারিবাহ আনন্দে এতটাই আপ্লুত হয়েছিলেন যে স্বেচ্ছায় আয়েশার (রা) পরিচারিকা হিসেবে রয়ে যান। তিনি আয়েশার (রা) সঙ্গেই থাকতেন এবং তাঁকে দেখভাল করতেন।]
এবার নবিজি (সা) বারিবাহকে ডাকলেন। অতি সন্ত্রস্ত বারিরাহ শুরুতে কথাই বলতে পারছিলেন না। নবিজি (সা) তাঁকে সরাসরি জিজ্ঞেস করলেন, “হে বারিবাহ, তুমি কি আয়েশার চরিত্র ও ব্যবহারের মধ্যে এমন কিছু দেখেছ যা তোমার মনে সন্দেহের সৃষ্টি করতে পারে?” “সাক্ষীর কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে বারিরাহর মনে হয়েছিল যে, তাঁকে সৎ থাকতে হবে এবং সেই সঙ্গে আয়েশার (সা) কিছু ত্রুটি-বিচ্যুতি বা দুর্বলতার কথাও উল্লেখ করতে হবে। তাই তিনি বললেন, “আল্লাহর কসম, হে আল্লাহর রসুল! আমি তাঁর মধ্যে এমন খারাপ কিছু কখনও দেখিনি। শুধু ময়দা মাখানোর সময় তিনি কখনও কখনও ঘুমিয়ে পড়তেন, সেই সময়ে ছাগল এসে তা খেয়ে ফেলত।”
সবার সাক্ষ্য থেকে পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছিল যে, আয়েশা (রা) সম্পূর্ণ নির্দোষ। ফলে নবিজি (সা) মনে কিছুটা স্বস্তি বোধ করলেন। আয়েশা (রা) তখনও শহরের বাইরে আওয়ালি নামক স্থানে তাঁর বাবার বাড়িতে অবস্থান করছিলেন। তারপর নবিজি (সা) মসজিদে একটি সাধারণ সভা আহ্বান করেন। পরিস্থিতি এতই নাজুক ও বিব্রতকর হয়ে পড়েছিল যে, তাঁকে সভা করে মদিনাবাসীকে সরাসরি জিজ্ঞেস করার প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল। তিনি সবার উদ্দেশ্যে বলেন, “সম্মিলিত মুমিনগণ, তোমরা কি আমাকে ক্ষমা করবে যদি আমি সে ব্যক্তির ব্যাপারে কিছু করি যে আমাকে আমার একান্ত পারিবারিক বিষয় নিয়ে আঘাত দিয়েছে?”
[নোট ২৬: অন্য কথায় তিনি বলছেন, তিনি যদি আব্দুল্লাহ ইবনে উবাই ইবনে সালুলের প্রতি রাগান্বিত হন, তাহলে সবাই তাকে আমাকে দোষ দেবে কি না। তিনি যদি আব্দুল্লাহ ইবনে উবাই কোনো শাস্তি দেন, তাহলে তারা নবিজিকে (সা) দোষ দেবেন কি না। তবে নবিজি (সা) তাঁর স্বভাবজাত শিষ্টাচারের কারণে নামটি উল্লেখ করেননি ।
নবিজি (সা) আরও বললেন, “হে আল্লাহ, আমি আমার স্ত্রীদের সম্পর্কে ভালো ছাড়া খারাপ কিছু জানি না।” এবার তিনি প্রকাশ্যে আয়েশাকে (সা) সমর্থন করে কথা বললেন। “এমনকি যে লোকটির (সাফওয়ান ইবনে মুয়াত্তাল) কথা তারা বলছে, তার সম্পর্কেও আমি ভালো ছাড়া খারাপ কিছু জানি না।”
তৎক্ষণাৎ সাদ ইবনে মুআদ (রা) (অথবা সম্ভবত উসায়েদ ইবনে হুদায়ের (রা) কিংবা আউসের তরুণ নেতাদের একজন) উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, “হে আল্লাহর রসুল, আমার পক্ষ থেকে আমি বলছি, আপনি সেই ব্যক্তির ব্যাপারে যা করতে চান তা করুন। সে যদি আউসের কেউ হয় তাহলে আমি নিজেই তার শির-েদ করব। আর সে যদি খাজরাজের কেউ হয় তাহলে কাজটি করার জন্য আমি আপনার আদেশের জন্য অপেক্ষা করব।”
[নোট ২৭: সাদ ইবনে মুআদ (রা) জানতেন, তখনও পর্যন্ত মুসলিম সমাজ থেকে জাহেলি যুগের মানসিকতা সম্পূর্ণভাবে দূর হয়নি। তাই তিনি কথা বলার সময় সতর্ক ছিলেন- লোকটি যদি খাজরাজের হয় তবে নবিজির (সা) আদেশের প্রয়োজন হবে। সভায় উপস্থিত সবাই জানত যে যার সম্পর্কে কথাগুলো বলা হচ্ছে সে খাজরাজ গোত্রের আবদুল্লাহ ইবনে উবাই।]
সাদ ইবনে মুআদ কথা শেষ করার সঙ্গে সঙ্গে সাদ ইবনে উবাদা নামের খাজরাজের একজন ক্রুদ্ধস্বরে বললেন, “আল্লাহর কসম, তুমি সত্য বলছ না। তুমি তাকে হত্যা করতে পার না। সে যদি তোমাদের উপজাতির কেউ হতো, তাহলে তো তাকে হত্যা করার সাহস দেখাতে না।”
লক্ষণীয় যে, খাজরাজের নেতা এখানে গোষ্ঠীবাদ সামনে নিয়ে আসছে। বর্ণনার এ পর্যায়ে আয়েশা (রা) সাদ ইবনে উবাদার পক্ষে একটি অজুহাত দেখান। তিনি বলেন, “এই বক্তব্য দেওয়ার আগে সাদ ইবনে উবাদা ছিলেন একজন ধার্মিক লোক। কিন্তু ধার্মিক হবার পরও তাঁর মধ্যে জাহেলি মানসিকতা বিদ্যমান ছিল (অর্থাৎ তিনি একটি ভুল করে ফেলেছেন, এ জন্য তাঁকে খারাপ ভেব না)।”
আমরা দেখছি, আয়ে’শা (রা) প্রত্যেকের ভুলের জন্যই কোনো না কোনো অজুহাত দিচ্ছেন ।] এই পর্যায়ে আউসের একজন দাঁড়িয়ে সাদ ইবনে উবাদাকে বললেন, “বরং তুমিই মিথ্যাবাদী। আমরা তাকে হত্যা করব! তুমি নিজে একজন মুনাফেক, আর এখন তুমি মুনাফেকদের পক্ষ নিয়ে কথা বলছ।” আলোচনা যেভাবে গড়াচ্ছিল তাতে মনে হচ্ছিল যে সভার আসল উদ্দেশ্যই ভেস্তে যেতে চলেছে । সভায় আবেগ-উত্তেজনা ক্রমেই বাড়ছিল। নবিজি (সা) দুই পক্ষকে শান্ত করার চেষ্টা করলেন।
[নোট ২৮; আবারও আমরা সাহাবিদের মধ্যে মানবিক প্রবৃত্তির বহিঃপ্রকাশ দেখতে পেলাম। মনে হচ্ছিল, উম্মতদের গোষ্ঠীবাদী মানসিকতা যেন-বা কখনই দূর হওয়ার নয় । একটি হাদিসে আছে, নবিজি (সা) বলেছেন, “আমার উম্মতদের মধ্যে জাহেলি যুগের চারটি বৈশিষ্ট্য রয়ে যাবে।” তিনি প্রথম যে দুটি বৈশিষ্ট্যের কথা উল্লেখ করেছিলেন তা হলো, বংশগৌরব এবং গোষ্ঠীবাদী মানোভাব ||
আয়ে’শা (রা) বর্ণনা করেছেন, “আমি সেদিন শুধু কেঁদেই যাচ্ছিলাম। আমি এতটাই কেঁদেছি যে, একপর্যায়ে আমার মনে হলো যেন আমার কলিজা ফেটে যাচ্ছে।” সম্ভবত কাঁদতে কাঁদতে তিনি বুকে ব্যথা অনুভব করতে শুরু করেছিলেন। তিনি আরও বলেন, “এ অবস্থায় এক আনসারি মহিলা আমার ঘরে প্রবেশের অনুমতি চাইল। এক সময় সে আমার পাশে বসে আমার সঙ্গে কান্না জুড়ে দিল।” আয়ে’শা (রা) বলেন, “আমরা যখন এভাবে কাঁদছিলাম, তখন নবিজি (সা) আমার ঘরে এলেন।”
[নোট ২৯: এটি ছিল আয়ে’শা (রা) তার বাবার বাড়ি চলে আসার দ্বিতীয় দিন। তিনি বাবার বাড়ি চলে আসার পর থেকে ঘটনাগুলো খুব দ্রুত ঘটছিল: আলি, উসামা ও বারিরাহর সাক্ষ্য গ্রহণ, তারপর সাধারণ সভা ইত্যাদি। লক্ষ করুন, নবিজি (রা) আয়ে’শাকে (রা) সুরক্ষা দিতে সচেষ্ট ছিলেন, কিন্তু আয়ে’শা (রা) নিজ বাড়িতে থাকার সময় তিনি কিছু করতে পারেননি। সেই কারণে গুজব আরও ডালপালা বিস্তারের সুযোগ পেয়েছিল।] নবিজি (সা) এই প্রথম এলেন আয়ে’শার (রা) সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করতে। প্রথমেই তিনি আল্লাহর প্রশংসা করলেন, তারপর বললেন, “আম্মা বাদ” (পর সমাচার এই যে…)।
নবিজি (সা) মূল প্রসঙ্গে গিয়ে বললেন, “আমি তোমার সম্পর্কে এমন এমন কথা শুনেছি। তুমি যদি নির্দোষ হয়ে থাক, তবে আল্লাহ তোমাকে এই অপবাদ থেকে মুক্তি দেবেন। আর যদি তুমি পাপের পথে গিয়ে থাক, তবে অনুতপ্ত হয়ে আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করো। নিশ্চয়ই বান্দা যখন কোনো পাপ করে এবং তারপর অনুতপ্ত হয়ে তওবা করে, আল্লাহ তার পাপ ক্ষমা করে দেন।”
[নোট ৩০০ লক্ষ করুন, নবিজি (সা) আয়ে’শার (সা) সঙ্গে কথা বলার সময় কোনো অভিযোগ আনেননি। তিনি শুধু বললেন, তুমি যদি নির্দোষ হও তবে আল্লাহ তোমাকে সাহায্য করবেন। তা না হলে তওবা করো, আল্লাহ সব ক্ষমা করে দেবেন। এ থেকে আমরা তওবার অপরিসীম গুরুত্বের প্রমাণ পাই। আয়ে’শা (রা) কোনো সাধারণ নারী ছিলেন না; তাঁর জন্য এটি কোনো সাধারণ পাপ ছিল না [কোরান, ৩৩:৩০]। শরিয়ত অনুসারে এই পাপের শাস্তি মৃত্যুদণ্ড; তবু নবিজি (সা) বলছেন, “তুমি যদি কোন পাপে লিপ্ত হয়ে থাক, তবে তওবা করো, আল্লাহ তোমাকে ক্ষমা করে দেবেন।” অর্থাৎ তওবা হলো পাপ থেকে রেহাই পাওয়ার মূল চাবিকাঠি।]
[নোট ৩১। গুজব রটার পর থেকে এক মাস আয়ে’শার (রা) বিষয়ে কোনো আয়াত নাজিল হয়নি। এই পুরোটা সময় নবিজি (সা) তীব্র মানসিক যন্ত্রণায় ছিলেন। কোরান যদি নবিজির (সা) কল্পনাপ্রসূত কোনো বার্তা বা গ্রন্থ হতো, তাহলে কেন তিনি পুরো একটা মাস ধরে এমন যন্ত্রণায় ভুগবেন? তিনি আল্লাহ তায়ালার কাছ থেকে ওহি আসার জন্য অপেক্ষা করছিলেন, কিন্তু জিব্রাইল (আ) আসেননি। কোরানের আয়াতে জিব্রাইল (আ) বলেছেন, “আমরা আপনার প্রতিপালকের আদেশ ছাড়া অবতরণ করি না।” [সুরা মরিয়ম, ১৯:৬৪]
এ থেকে সন্দেহাতীতভাবে বোঝা যায়, মুহাম্মদ (সা) একজন সত্য নবি ছিলেন। তিনি যদি একজন ভুয়া নবি হতেন তবে ঘটনার পরের দিনই ওহি এনে তিনি আয়েশাকে (রা) বলতে পারতেন, তুমি নির্দোষ। এ নিয়ে ভেবো না ।] আয়েশা (রা) বর্ণনা করেছেন, “যখন নবিজি (সা) কথা শেষ করলেন, তখন আমি কান্না থামালাম। আমি অনুভব করলাম, আমার চোখের পানি শুকিয়ে এসেছে।” এ পর্যায়ে নবিজির ওপর তাঁর রাগ হচ্ছিল। কারণ তাঁর মনে হচ্ছিল, নবিজি (সা) কি আসলেই এই গুজবে বিশ্বাস করেন? তিনি কি ভেবেছেন যে এটি সত্যি হলেও হতে পারে? তিনি তাঁর মা উম্মে রুমানকে বললেন, “মা, আপনি আমার হয়ে নবিজিকে (সা) উত্তর দিন।”
উম্মে রুমান বললেন, “আল্লাহর কসম, মামনি, কী বলব আমি তা আমি জানি না ।” এবার আয়েশা (রা) পিতা আবু বকরের (রা) দিকে মুখ ফিরিয়ে বললেন, “বাবা, তাঁকে উত্তর দিন।” আবু বকরের (রা) সামনে একদিকে ছিলেন আল্লাহর রসুল (সা) অন্যদিকে তার নিজের কন্যা। তিনি এখন কী করবেন? কার পক্ষ নেবেন? তিনি শুধু বললেন, “আমার প্রিয় মামনি, আমি কী বলব আমি তা জানি না। আয়েশা (রা) বুঝতে পারলেন, বাবা-মা তাঁর পক্ষে দাঁড়াবেন না। আর তাঁরা কী-ই বা বলবেন, যেখানে আল্লাহর রসুল (সা) তাদের সামনে বসে আছেন। তখন তিনি নবিজিকে (সা) সাহস ও বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে বললেন, “আপনাকে এখন আমি শুধু তা-ই বলতে পারি যা ইউসুফের (আ) পিতা বলেছিলেন:
“ধৈর্য ধরাই আমার পক্ষে শ্রেয়। তোমরা যা বলছ সে বিষয়ে একমাত্র আল্লাহই আমার ভরসা।” [সুরা ইউসুফ, ১২:১৮]
আয়েশা (রা) পরে বলেন, “আমি তখনও ছিলাম একজন অল্পবয়সী কিশোরী, কোরানের বেশিরভাগই আমার মুখস্থ ছিল না। আমি তখন ইয়াকুবের (আ) নাম মনে করতে পারিনি, তাই আমি বলেছিলাম, “ইউসুফের (আ) পিতা।” অর্থাৎ আয়েশা (রা) বোঝাতে চেয়েছিলেন, তাঁর সম্পর্কে যে কাহিনি রটেছে তা সম্পূর্ণভাবে মিথ্যা।
কেউ তাঁর পাশে দাঁড়াবে সে আশা তিনি ছেড়ে দিয়েছেন। এখন তিনি শুধু ধৈর্য ধরে আল্লাহ তায়ালার কাছে সাহায্য চাইবেন এবং আল্লাহই তাঁকে সাহায্য করবেন। তিনি একাকী ও নিঃসঙ্গ বোধ করতে লাগলেন। তিনি এবার দেওয়ালের দিকে মুখ দিয়ে পাশ ফিরে শুলেন। পরবর্তী সময়ে তিনি এই কাহিনি বর্ণনা করার সময় বলেছিলেন, “আমি জানতাম আল্লাহ শেষ পর্যন্ত আমার সততার বিষয়টি প্রকাশ করবেন, হতে পারে তা নবিজিকে (সা) স্বপ্ন দেখানোর মধ্য দিয়ে। কিন্তু আমি স্বপ্নেও ভাবিনি যে আল্লাহ আমার সম্পর্কে কোরানে আয়াত নাজিল করবেন। “
আরও পড়ুনঃ