প্রাক-ইসলামি আরব হুনাফা | ইসলাম-পূর্ব বিশ্বে ধর্মীয় পরিস্থিতি | মহানবী হযরত মুহাম্মদ সাঃ জীবন

প্রাক-ইসলামি আরব হুনাফা | ইসলাম-পূর্ব বিশ্বে ধর্মীয় পরিস্থিতি, প্রাক-ইসলামি আরবে সবাই যে পৌত্তলিক ছিল তা নয়। সেখানে কিছু ব্যতিক্রমও ছিল। সেই সময়ের কিছু মানুষের কথা জানা যায় যারা ছিল ‘হানিফ’ (বহুবচন হুনাফা), যার আক্ষরিক অর্থ ‘মুখ ফিরিয়ে নেওয়া। অর্থাৎ তারা আল্লাহর সঙ্গে অন্য কাউকে অংশীদার করা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল। হানিফদের মধ্যে একজন ছিলেন কুস ইবনে সাইদা। তিনি ছিলেন বনু লাইন সম্প্রদায়ের। মহানবি মুহাম্মদের (সা) বয়স যখন ২০ বছর, কুস তখন ৮০-৯০ বছরের একজন বৃদ্ধ। কুস ইবনে সাইদা হজের জন্য মক্কায় আসতেন এবং সেখানে আগত মানুষদের মধ্যে মূর্তিপূজার বিরুদ্ধে প্রচারণা চালাতেন।

তিনি কবিদের মতো করে আলঙ্কারিক ভাষায় কথা বলতে পারতেন, এবং যে কোনো বিষয় চমৎকার করে বুঝিয়ে উপস্থাপন করতে পারতেন। যেমন তিনি বলতেন, “হে লোকেরা! তোমরা আমার কথা শোনো এবং বুঝতে চেষ্টা করো। আর শুনলেই তোমরা উপকার পাবে। সব জীবিত মানুষই একদিন মৃত্যুবরণ করবে। আর তখনই আল্লাহ যা লিখে রেখেছেন তার সবই সত্য বলে প্রমাণিত হবে।” তিনি আরও বলতেন, “হে লাইদ সম্প্রদায়। আজ কোথায় সামুদ, আর কোথায় আদ? আর তোমাদের পিতা-পিতামহরাই বা কোথায়? আল্লাহর কসম, তোমরা যে ধর্মের উপর রয়েছ, তার চেয়ে আরও ভালো কোনো ধর্ম নিশ্চিতভাবেই রয়েছে।”

 

প্রাক-ইসলামি আরব হুনাফা | ইসলাম-পূর্ব বিশ্বে ধর্মীয় পরিস্থিতি | মহানবী হযরত মুহাম্মদ সাঃ জীবন

 

প্রাক-ইসলামি আরব হুনাফা | ইসলাম-পূর্ব বিশ্বে ধর্মীয় পরিস্থিতি | মহানবী হযরত মুহাম্মদ সাঃ জীবন

জানা যায়, অনেক বছর পরে নবম হিজরি সালে যখন বনু লাইদ সম্প্রদায়। ইসলাম গ্রহণ করতে মদিনায় আসে, তখন নবিজি (সা) তাদের কুস ইবনে সাইদার কথা জিজ্ঞেস করেছিলেন। তারা জানিয়েছিল, তিনি অনেক আগেই মৃত্যুবরণ করেছেন। শুনে নবিজি (সা) বলেছিলেন, “আমি তাকে একবার একটি লাল উটে উপবিষ্ট অবস্থায় দেখেছি বলে মনে করতে পারি। তিনি তাঁর কথা দিয়ে মানুষকে সম্মোহিত করতে পারতেন। তোমাদের মধ্যে কারও কি সেটা মনে আছে?” এ থেকে বোঝা যায়, কুস যা বলতেন তা নবিজি (সা) পছন্দ করেছিলেন। এ থেকে আরও বোঝা যায় যে সে সময় তওহিদ বা একেশ্বরবাদেরও কিছু কিছু চর্চা ছিল।

তখনকার সময়ের হানিফদের মধ্যে চারজন ছিলেন সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ ও প্রসিদ্ধ। এ ব্যাপারে ইবনে হিশাম খুব সুন্দর একটি কাহিনি বর্ণনা করেছেন। মহানবি মুহাম্মদের (সা) জন্মের আগে কুরাইশরা একবার মক্কা শহরের বাইরে একটি বিশাল উৎসবের আয়োজন করেছিল। সেখানে তাদের প্রতিমাগুলোকে তাওয়াফ করার ব্যবস্থা ছিল। পুরো মক্কার লোকজন ওই উৎসবে যোগ দিতে রগুনা হলেও ওই চারজন হানিফ শহরেই রয়ে যান। তাঁরা ছিলেন:

ক) ওয়ারাকা ইবনে নওফাল ইবনে আসাদ খাদিজার (রা) পিতা ছিলেন খুওয়ালিদ ইবনে আসাদ। ওয়ারাকা ও খাদিজা (রা) ছিলেন পরস্পরের চাচাতো ভাইবোন। তবে ওয়ারাকা খাদিজার (রা) চেয়ে বয়সে ৪০ বছরের বড় ছিলেন।

খ) উবায়দুল্লাহ ইবনে জাহশ তিনি ছিলেন মহানবি মুহাম্মদের (সা) (ফুপাতো ভাই। উবায়দুল্লাহর মা ছিলেন নবিজির (সা) ফুপু (অর্থাৎ আবদুল মুত্তালিবের কন্যা)।

গ) উসমান ইবনুল হুয়াইরিস

ঘ) জায়েদ ইবনে আমর ইবনে নুফায়েল তিনি ছিলেন উমর ইবনুল খাত্তাব ইবনে নুফায়েলের (রা) প্রথম কাজিন (চাচাতো ভাই)। তবে জায়েদ উমরের (রা) চেয়ে বয়সে আনুমানিক ৪০ বছরের বড় ছিলেন। যখন ওই চার হুনাফা দেখলেন, তাঁদের কেউই শহরের বাইরের প্রতিমাপূজায় যোগ দেননি, তখন তাঁরা প্রত্যেকেই বুঝতে পারলেন যে তওহিদের বিষয়ে চারজনই একই মতের অনুসারী। অতএব তাঁরা একে অপরের সঙ্গে বন্ধুত্বের বন্ধনে আবদ্ধ হলেন। তাঁরা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিলেন যে তাঁরা ইব্রাহিমের (আ) মূল ধর্মের অনুসন্ধান করবেন। তারপর তাঁরা সবাই আলাদা হয়ে গিয়ে সত্য পথের সন্ধানে মক্কা ত্যাগ করলেন।

 

islamiagoln.com google news
আমাদের গুগল নিউজে ফলো করুন

 

তাঁদের মধ্যে ওয়ারাকা ইবনে নওফাল শেষ পর্যন্ত কুরাইশদের ধর্ম প্রত্যাখ্যান করে খ্রিষ্টধর্ম বেছে নিয়েছিলেন। নবিজির (সা) নবুয়তের সময় ওয়ারাকার বয়স ছিল ৮০ বছরেরও বেশি। তিনি তখন অন্ধ হয়ে গিয়েছিলেন। সবাই জানত যে তিনি একজন বিদ্বান ব্যক্তি ছিলেন, যিনি হিব্রু ও আরামিক ভাষায় পড়তে ও লিখতে পারতেন।

প্রথম ওহি নাজিল হওয়ার পর নবিজি (সা) উদভ্রান্তের মতো বাসায় ফিরে এলে খাদিজা (রা) সব শুনে বললেন, “চলুন, আমরা ওয়ারাকার কাছে যাই।” নবিজির (সা) কাছে ঘটনার বর্ণনা শুনেই ওয়ারাকা বুঝতে পারেন যে, এটিই সেই ধর্ম যার জন্য তাঁরা অপেক্ষা করছিলেন। এমনকি সেই সময় মুহাম্মদ নিজেও (সা) বুঝতে পারেননি যে তিনি আল্লাহ কর্তৃক প্রেরিত একজন নবি হতে চলেছেন। কিন্তু ওয়ারাকা তৎক্ষণাৎ বুঝতে পেরেছিলেন যে মুহাম্মদের (সা) কাছে যে এসেছিল আর মুসা ও ইসার কাছে যে এসেছিল তারা একই সত্তা (অর্থাৎ জিব্রাইল)।

তিনি তখন মুহাম্মদকে (সা) বললেন, “তোমার লোকেরা যখন তোমাকে নির্যাতন করবে এবং বহিষ্কার করবে, আমি যদি তখন যুবক থাকতাম তাহলে তোমাকে সাহায্য করতে পারতাম।” একথা শুনে নবিজি (সা) অবাক হয়ে বলেছিলেন, “আমার লোকেরা আমাকে বহিষ্কার করবে?” ওয়ারাকা উত্তরে বলেছিলেন, “হ্যাঁ! এমন কোনো নবি আসেনি যাকে তার সম্প্রদায়ের লোকেরা বাধা দেয়নি।” এই ঘটনার কিছুদিন পরেই ওয়ারাকা মৃত্যুবরণ করেন।

উবায়দুল্লাহ ইবনে জাহশের কাহিনিটা সবচেয়ে দুঃখজনক। তিনি প্রথমে খ্রিষ্টধর্মে দীক্ষা নিয়েছিলেন। নবি করিম (সা) ইসলাম প্রচার শুরু করার পর তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন। পরবর্তী সময়ে তিনি উম্মে হাবিবাকে বিয়ে করেন এবং আবিসিনিয়ায় পাড়ি জমান। কিন্তু তারপরে তিনি আবার খ্রিষ্টধর্মে ফিরে যান। এর ফলে উম্মে হাবিবা তাঁকে ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হন। বিচ্ছেদের কিছুদিনের মধ্যেই উবায়দুল্লাহ মারা যান। পরে উম্মে হাবিবা নবি করিমকে (সা) বিয়ে করেছিলেন।

উসমান ইবনুল হুয়াইরিসও খ্রিষ্টধর্ম গ্রহণ করেছিলেন এবং আমৃত্যু ওই ধর্মের অনুসারীই ছিলেন। আমরা জানি না তাঁর কাছে ইসলামের বাণী পৌঁছেছিল কি না। কারণ মহানবি মুহাম্মদের (সা) জন্মের আগেই তিনি মক্কা ত্যাগ করেন। উসমান ইবনুল হুয়াইরিস পরে রোম যান এবং সেখানে তিনি দোভাষীর কাজ করেন।

 

প্রাক-ইসলামি আরব হুনাফা | ইসলাম-পূর্ব বিশ্বে ধর্মীয় পরিস্থিতি | মহানবী হযরত মুহাম্মদ সাঃ জীবন

 

জায়েদ ইবনে আমর ইবনে নুফায়েল খ্রিষ্টধর্ম বা ইহুদি ধর্ম গ্রহণ করেননি। বর্ণিত আছে যে, তিনি ‘রাবাই ও পুরোহিত উভয়দেরই বলতেন, “এটি ইব্রাহিমের ধর্ম নয়, এবং আপনারাও তা জানেন।” শেষ পর্যন্ত তিনি মক্কায় ফিরে যান। তিনি কুরাইশদের বলতেন, “এই শহরে আমি ছাড়া ইব্রাহিমের (আ) প্রকৃত অনুসারী আর কেউ নেই।”

নরিপত্নী আয়েশার বড় বোন আসমা বিনতে আবুবকর ছোটবেলার স্মৃতি থেকে বর্ণনা করেছেন যে, তিনি জায়েদ ইবনে আমরকে প্রতিমাপূজা, প্রতিমাদের গোস্ত দেওয়া বা কন্যাসন্তানদের জীবিত কবর দেওয়ার জন্য কুরাইশদের তিরস্কার করতে দেখেছিলেন। যখন কোনো কুরাইশ তার কন্যাসন্তানকে হত্যা করতে চাইত, জায়েদ তখন বলতেন, “তাকে আমার হাতে তুলে দাও, আমি লালন- পালন করব। সে আমার কন্যা হিসেবে বড় হবে।” সুতরাং কুরাইশরা যে কন্যাসন্তানদের হত্যা করতে চাইত তাদের তিনি লালন-পালনের জন্য গ্রহণ করতেন। এর মাধ্যমে আমরা তাঁর উদারতা ও কোমল হৃদয়ের বহিঃপ্রকাশ দেখতে পাই। 

তিনি নিজে কোনো দিন প্রতিমায় অংশ নেন। मনা যায়, মহান হ (স) তাঁর নবুওতের আগে একবার জায়েদ ইবনে আমরের সঙ্গে দেখা করে জিজ্ঞেস করেছিলেন, “আপনার সঙ্গে আপনার সম্প্রদায়ের বৈরিতার কারণ কী জায়েদ উত্তরে বলেছিলেন, “আমার পক্ষে প্রতিমাপূজা করা কখনও সম্ভব নয়।” মৰিজি (সা) নিজের কখনও কোনো প্রতিমার পূজা করেননি। তাই তিনি জায়েদ ইবনে আমরের সঙ্গে নিজের আত্মার যোগসূত্র খুঁজে পেয়েছিলেন।

জায়েদ ইবনে আমর তওহিদের ওপর দৃঢ়ভাবে বিশ্বাসী ছিলেন। তিনি মহানবি মুহাম্মদের (সা) নবুয়তের পাঁচ বছর আগে মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর পুত্র সাইদ ইবনে জায়েদ ছিলেন একজন বিশিষ্ট সাহাবি এবং “আশারা মুবাশারা’ (জান্নাতের প্রতিশ্রুতিপ্রাপ্ত দশজনের মধ্যে একজন)। সাইদ একবার নবিজিকে (সা) জিজ্ঞেস করেছিলেন, “হে আল্লাহর রসুল। আখেরাতে আমার পিতার ভাগ্যে কী আছে তা আমাকে বলুন।” জবাবে নবিজি (সা) বলেছিলেন, “কেয়ামতের দিন। তাঁকে তাঁর নিজের উম্মত হিসেবে পুনরুত্থিত করা হবে।” অর্থাৎ তিনি ছিলেন এক ব্যক্তিবিশিষ্ট উম্মাহ, কোনো নবি ছাড়া একমাত্র উম্মাহ। নবি করিম (সা) মিরাজ থেকে ফিরে সাইদকে বলেন, “আমি তোমার পিতাকে জান্নাতে দেখতে পেয়েছি। আল্লাহ তাঁকে একটি নয়, দুটি দিয়েছেন।” এ থেকে বোঝা যায়, ইসলাম আসার আগের মানুষরাও জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে, যেহেতু তারা তাদের “ফিতরাহ’র” কারণে পৌত্তলিকতা ও প্রতিমাপূজা প্রত্যাখ্যান করেছিল।

আরো পড়ুনঃ

Leave a Comment