মাকামাতে হারিরী বাংলা pdf download

মাকামাতে হারিরী আরবি সাহিত্যের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। এটি রচনায় ব্যবহৃত হয়েছে উপদেশমূলক ও রসাত্মক বর্ণনার এক চমৎকার ধাঁচ, যা ‘মাকামা’ নামে পরিচিত। মাকামা বলতে সাধারণত রম্য রচনার ভঙ্গিতে উপদেশ ও চতুর কথোপকথন দ্বারা গঠিত ছোটগল্প বোঝায়। এই ধারার দুইজন প্রধান রচয়িতা হলেন বদীউজ্জামান আল-হামদানী ও আবু মুহাম্মদ কাসেম ইবনে আলী আল-হারিরি।

মাকামাতে হারিরী রচনা শুরু হয় ৪৯৫ হিজরিতে এবং সমাপ্ত হয় ৫০৪ হিজরিতে। এর রচয়িতা হারিরি ছিলেন ভাষার জাদুকর। শব্দ চয়ন, উপমা, অলংকার ও ব্যঙ্গাত্মক রম্যরচনার মাধ্যমে তিনি আরবি ভাষা ও সাহিত্যের নান্দনিক সৌন্দর্য ফুটিয়ে তুলেছেন। এ কারণেই এটি দীর্ঘদিন ধরে কওমি মাদরাসাসমূহে পাঠ্য হিসেবে পড়ানো হয়।

মাকামাতে হারিরী বাংলা pdf download

 

Table of Contents

মাকামাতে হারিরী

 

মাকামাতে হারিরী বাংলা pdf download

 

মাকামাতে হারিরীর ছবি সহ মুল সংস্করণ
মাকামাতে হারিরীর ছবি সহ মুল সংস্করণ

 

পাণ্ডুলিপি ও চিত্রায়ন: শিল্প ও ইতিহাসের মেলবন্ধন

মাকামাগুলোর প্রথম পরিচিত পাণ্ডুলিপি পাওয়া যায় ১৩ শতকে। পরবর্তীতে আরও সাতটি সচিত্র পাণ্ডুলিপির সন্ধান মেলে। এদের মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত হলো ১২৩৭ সালে বাগদাদে নির্মিত একটি পাণ্ডুলিপি, যা বর্তমানে ফ্রান্সের Bibliothèque nationale de France-এ সংরক্ষিত আছে। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ পাণ্ডুলিপি ১৩৩৪ সালে মিশর বা সিরিয়ায় রচিত হয়, যা বর্তমানে Austrian National Library-তে রক্ষিত।

সব মিলিয়ে একশোরও বেশি মাকামা পাণ্ডুলিপির অস্তিত্ব জানা গেলেও মাত্র তেরোটি পাণ্ডুলিপি চিত্রায়িত। এই চিত্রিত পাণ্ডুলিপিগুলো প্রায় ১৫০ বছরব্যাপী সময়ে নির্মিত হয়েছে। এদের মধ্যে প্রথম পর্যায়ের পাণ্ডুলিপিগুলো ১২০০ থেকে ১২৫৬ সালের মধ্যে সিরিয়া ও ইরাক অঞ্চলে সৃষ্ট হয়। এরপর আসে প্রায় ৫০ বছরের একটি শূন্যতা, যা মঙ্গোল আক্রমণের (বিশেষ করে ১২৫৮ সালের বাগদাদ অবরোধ) সাথে সম্পর্কযুক্ত বলে ধারণা করা হয়। দ্বিতীয় পর্যায়ের চিত্রিত পাণ্ডুলিপিগুলো ১৩০০ থেকে ১৩৩৭ সালের মধ্যে মিশরের মামলুক শাসনামলে, সম্ভবত কায়রোকে কেন্দ্র করে তৈরি হয়।

 

মাকামাতে হারিরীর ছবি সহ মুল সংস্করণ
মাকামাতে হারিরীর ছবি সহ মুল সংস্করণ

 

ধর্মনিরপেক্ষ আরবি সাহিত্যের দলিল

মাকামাতে হারিরীর পাণ্ডুলিপিগুলোকে “ধর্মনিরপেক্ষ আরবি পাণ্ডুলিপি” হিসেবে শ্রেণিবদ্ধ করা হয়। এগুলো শুধু সাহিত্যিক উৎকর্ষের নিদর্শন নয়, বরং মধ্যযুগীয় আরবি সমাজ, সংস্কৃতি ও শিল্পকলার মূল্যবান ঐতিহাসিক দলিলও বটে।

মাকামাতে হারিরীর ছবি সহ মুল সংস্করণ
মাকামাতে হারিরীর ছবি সহ মুল সংস্করণ

 

 

 

হারিরী ও তাঁর যুগ – ইতিহাস ও সাহিত্যিক প্রেক্ষাপট

হারিরী: পরিচয়

আবু মুহাম্মদ আল-কাসিম ইবনু আলী আল-হারিরী (আবুল কাসিম হারিরী নামে পরিচিত) ছিলেন মধ্যযুগীয় আরবি সাহিত্যের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। তাঁর জন্ম ১০৫৪ খ্রিস্টাব্দে (হিজরি ৪৪৬) ইরাকের বসরা শহরে। তিনি ছিলেন একজন আরবি ভাষাবিদ, কাব্যরসিক, ধর্মজ্ঞ ও চমৎকার গদ্যশিল্পী। তবে যেই পরিচয়ে তিনি চিরস্মরণীয় হয়ে আছেন, তা হলো তাঁর বিখ্যাত সাহিত্যকর্ম মাকামাতে হারিরী’

হারিরী ছিলেন অত্যন্ত উচ্চশিক্ষিত, তিনি আরবি ব্যাকরণ, অলংকার, ভাষাশাস্ত্র ও ধর্মীয় বিদ্যায় সুপণ্ডিত ছিলেন। তাঁর পাণ্ডিত্যপূর্ণ রচনার মধ্য দিয়ে বোঝা যায়, তিনি কেবল সাহিত্যিক নন, বরং একজন দক্ষ ভাষা বিশারদ, যিনি ভাষার খুঁটিনাটি সৌন্দর্য আবিষ্কার ও প্রদর্শনে পারদর্শী ছিলেন।

 

হারিরীর যুগ – একটি উন্মুখ ও রূপান্তরময় সময়

হারিরী যে সময়ের মানুষ, তা ছিল আব্বাসীয় খেলাফতের অন্তিম পর্যায়। যদিও তখনও খেলাফত টিকে ছিল, কিন্তু রাজনৈতিকভাবে সেটা ছিল বেশ দুর্বল। বসরা, বাগদাদ, কুফা, দামেস্ক, কায়রো প্রভৃতি শহরে তখন একদিকে সাংস্কৃতিক জাগরণ, অন্যদিকে ভৌগোলিক ও রাজনৈতিক বিচ্ছিন্নতা চলছিল।

তবে এই রাজনৈতিক সংকটের মধ্যেও সাহিত্য, বিজ্ঞান, ভাষা ধর্মতত্ত্ব নিয়ে মুসলিম বিশ্বে ব্যাপক চর্চা হচ্ছিল। আরবি ভাষা ছিল তখন জ্ঞানের ভাষা—চিকিৎসা, গণিত, জ্যোতির্বিজ্ঞান, ইসলামি ফিকহ, দর্শন এবং সাহিত্যের প্রধান বাহন। এই উর্বর পরিবেশে হারিরীর মতো লেখকের জন্ম ও বিকাশ সম্ভব হয়েছিল।

 

সাহিত্যিক পরিবেশ

এই সময়টি ছিল আরবি গদ্যসাহিত্যের একটি উজ্জ্বল পর্ব। সাহিত্যে কবিতা বহুদিন ধরেই রাজত্ব করছিল, তবে গদ্য সাহিত্যে এক নতুন ধারা উদ্ভব হয়: মাকামা (مقامة)

মাকামা হল সাহিত্যিক গদ্য রচনার একটি বিশেষ ধরণ, যেখানে সাহিত্যিক চাতুর্য, শব্দের খেলা, অলংকারপূর্ণ ভাষা এবং রম্য অথচ উপদেশমূলক কাহিনি একত্রিত হয়। এই ধারার সূচনা করেন বদি আল-যামান আল-হামাদানি (৯৬৮–১০০৮), আর এই ধারাকে শ্রেষ্ঠ উচ্চতায় পৌঁছে দেন হারিরী।

হারিরীর সময়কালে সাহিত্যপ্রেমীরা শুধু কাহিনি নয়, ভাষার সৌন্দর্য, বাকচাতুর্য, ব্যাকরণগত উৎকর্ষ এবং ছন্দময়তার প্রতি গভীরভাবে আকৃষ্ট ছিলেন। এই রুচিসম্মত ও জ্ঞাননির্ভর পাঠকগোষ্ঠীর জন্য হারিরীর লেখা ছিল এক অসাধারণ উপহার।

 

মুখের ভাষা থেকে লিখিত শিল্পে উত্তরণ

হারিরী মুখের বাগ্মীতাকে সাহিত্যিক লেখনীর উচ্চতায় পৌঁছে দেন। তাঁর মাকামাগুলো মৌখিক গল্প বলার আদলে রচিত হলেও তা গদ্য কাব্যের মেলবন্ধনে পরিণত হয়।

এই সময় আরবি সাহিত্যে বর্ণনাধর্মী রচনার চাহিদা বাড়ছিল, কিন্তু পাঠকেরা চাইত এমন কিছু যা ভাষাগতভাবে চ্যালেঞ্জিং এবং মনোমুগ্ধকর। হারিরীর মাকামাগুলো সেই চাহিদার যোগান দেয় এবং ধীরে ধীরে তা আধুনিক আরবি গদ্যসাহিত্যের ভিত্তিপ্রস্তর হয়ে ওঠে।

 

হারিরীর বুদ্ধিদীপ্ত উপস্থাপনা

হারিরীর রচনায় নৈতিকতা, ধর্ম, সামাজিক ব্যঙ্গ এবং জ্ঞানরসের মিশ্রণ ছিল। তিনি ভাষার খেলা দিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন যে একজন সাহিত্যিক শুধু গল্প বলার কারিগর নয়, বরং সমাজ বিশ্লেষক ও ভাষার স্থপতি।

তাঁর কাহিনির চরিত্ররা চালাক, কথা-চতুর, সুযোগসন্ধানী। তাদের কথার বাঁকে বাঁকে লুকানো থাকে হাস্যরস, কৌতুক ও বিদ্রূপ। এর পেছনে ছিল হারিরীর সমাজ-পর্যবেক্ষণ আর বিদগ্ধতা।

 

মাকামা সাহিত্যধারার উৎপত্তি ও বিকাশ – হামাদানি থেকে হারিরী

‘মাকামা’—একটি বিশেষ সাহিত্যিক গদ্যধারা

‘মাকামা’ (مقامة) শব্দের অর্থ দাঁড়ায় “অবস্থান”, “সমাবেশ” বা “উপস্থাপনা”। আরবি সাহিত্যে এটি একটি সাহিত্যিক গদ্যরীতি, যেখানে একটি নির্দিষ্ট চরিত্র বা কাহিনির কেন্দ্রে দাঁড়িয়ে থাকে কথোপকথন, কল্পনা, হাস্যরস এবং ভাষার চাতুর্য

‘মাকামা’ হল একদিকে উপদেশমূলক গল্প—আবার অন্যদিকে তা ভাষার দার্শনিক খেলা। এটি এমন এক ধারা যেখানে সাহিত্যকর্ম শুধুমাত্র গল্প নয়, বরং ভাষার নান্দনিক রূপও।

 

মাকামার জন্ম: বদি আল-যামান আল-হামাদানি

মাকামা ধারার জন্মদাতা হিসেবে সর্বসম্মতভাবে স্বীকৃত বদি আলযামান আলহামাদানি (৯৬৮১০০৮)। তিনি প্রায় ৪০০টির বেশি মাকামা রচনা করেছিলেন, যদিও তার মধ্যে মাত্র ৫২টি সংরক্ষিত আছে।

হামাদানি এই ধারার মাধ্যমে আরবি গদ্য সাহিত্যে এক বিপ্লব ঘটান। তাঁর রচনায় শব্দচাতুর্য, শব্দকল্পনা, কাব্যিক গদ্য হাস্যরসের অসাধারণ সংমিশ্রণ ছিল। প্রতিটি মাকামায় একটি চরিত্র—আবু আলফাতহ আলইস্কান্দারি—যিনি কথার খেলায় শ্রোতাকে মুগ্ধ করেন, এবং একজন ধারাভাষ্যকার—ইসা ইবনে হিশাম

এই চরিত্রদ্বয়ের মধ্য দিয়ে পাঠক নানা ধরনের অভিজ্ঞতা অর্জন করেন—ধূর্ততা, প্রতারণা, জ্ঞান, অভাব, ভ্রমণ, দরিদ্রতা ইত্যাদি।

 

হারিরীর হাত ধরে ধারাটির পরিণতি

হামাদানির হাতে এই সাহিত্যিক ধারা প্রতিষ্ঠিত হলেও, আলহারিরী-র মাধ্যমে এই ধারাটি পৌঁছায় তার শীর্ষে।

হারিরী তাঁর মাকামাতে হারিরী-তে মোট ৫০টি মাকামা রচনা করেন। এখানেও হামাদানির আদলে থাকছে দুটি প্রধান চরিত্র—
১️⃣ আবু জায়েদ আলসারুজী (ধূর্ত, কথায় পটু, চাতুর্যবান)
২️⃣ আলহারিস ইবনে হাম্মাম (শ্রোতা ও ধারাভাষ্যকার)

তবে হামাদানির তুলনায় হারিরীর মাকামাগুলো আরও বেশি ভাষাবিদ্যামূলক, ব্যাকরণসম্মত, অলংকারপূর্ণ ছন্দনির্ভর। তিনি আরবি ভাষার শব্দ সম্ভার, ব্যাকরণিক নিপুণতা ও অলংকারের অসাধারণ প্রয়োগ ঘটান।

 

হামাদানি ও হারিরীর পার্থক্য

দিকহামাদানিহারিরী
সময়১০ম শতাব্দী১১শ শতাব্দী
রচনা সংখ্যাপ্রায় ৪০০ (৫২ বিদ্যমান)৫০টি
ভাষার ব্যবহারকল্পনাশ্রিত, সাহিত্যমূল্য বেশিভাষা-প্রযুক্তির দিক থেকে শ্রেষ্ঠ
কাহিনির ধরণকল্পনাধর্মী ও রম্যশিক্ষামূলক ও ভাষা-কেন্দ্রিক
চরিত্রআবু আল-ফাতহআবু জায়েদ

 

কেন মাকামা ধারাটি গুরুত্বপূর্ণ?

১. ভাষার শুদ্ধতা সৌন্দর্য প্রকাশে মাকামা একটি যুগান্তকারী রীতি।
২. এটি সাহিত্য ও ব্যাকরণের সংমিশ্রণ ঘটায়।
৩. শিক্ষিত পাঠকের জন্য এটি ছিল একধরনের বুদ্ধিবৃত্তিক বিনোদন
৪. সমাজের বিভিন্ন স্তরের বাস্তবতা, প্রতারণা, ভিক্ষাবৃত্তি, বাগ্মিতা—সব উঠে আসে চতুর কাহিনিতে।
৫. অনেক ক্ষেত্রে এর ভাষাগত উৎকর্ষ কোরআনের পর সবচেয়ে সমৃদ্ধ বিবেচিত হয়েছে।

 

মাকামা – সাহিত্যের এক বিশেষ চূড়ান্তত্ব

মাকামা ধারার প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে—

  • রাইমড প্রোজ (সাজেয়া গদ্য)
  • কাব্য গদ্যের সংমিশ্রণ
  • উপদেশমূলক হাস্যরস
  • ভাষাবিদ্যাগত চমৎকারিত্ব

হারিরীর মাকামাগুলো এতটাই সমৃদ্ধ যে, এগুলো শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে আরবি ব্যাকরণ, অলংকারশাস্ত্র ভাষাচর্চার পাঠ্যপুস্তক হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে।

 

মাকামাতে হারিরীর কাঠামো ও রচনাশৈলী

রচনার গঠন ও কৌশল

আলহারিরী রচিত মাকামাতে হারিরী একটি ভাষাশিল্পের বিস্ময়। প্রতিটি মাকামা (গল্প) গঠিত একটি স্বতন্ত্র কাঠামোয়, যেখানে রয়েছে—

  1. ভূমিকা (Prologue) – গল্পের শুরুতে এক চমৎকার ভূমিকা দিয়ে পাঠককে কাহিনির মধ্যে টেনে আনা হয়।
  2. ধারাভাষ্যকারের বর্ণনা (Narrator’s View) – ধারাভাষ্যকার আলহারিস ইবনে হাম্মাম বলেন, তিনি কোনো এক জায়গায় ভ্রমণে গিয়ে এক আশ্চর্য ব্যক্তির (আবু জায়েদ) সাথে দেখা পান।
  3. প্রধান চরিত্রের আবির্ভাব (Entry of Abu Zayd) – আবু জায়েদ ভাষার কারুকার্যে এক বা একাধিক সমস্যার সমাধান করেন, গল্প বলেন বা প্রতারণা করে বেঁচে যান।
  4. ঘটনার চমক (Climax) – কোথাও প্রতারণা, কোথাও দার্শনিক আলোচনার মাধ্যমে আবু জায়েদ জয়ী হন।
  5. উপসংহার উপলব্ধি (Moral or Irony) – শেষ অংশে আল-হারিস জানান তিনি ধোঁকা খেয়েছেন, মুগ্ধ হয়েছেন অথবা নতুন কিছু শিখেছেন।

 

ভাষার অলংকার ও শৈলী

মাকামাতে হারিরীর সবচেয়ে চিত্তাকর্ষক দিক হলো এর ভাষাশৈলী। তিনি আরবি ভাষার সবচেয়ে সূক্ষ্ম অলংকার, ছন্দ, এবং ব্যাকরণিক নিপুণতা ব্যবহার করেছেন। এর মধ্যে আছে:

  • সাজেয়া গদ্য (Saj’) – ছন্দময় গদ্য যা কোরআন ও হাদীসের ভাষার অনুরূপ।
  • সমাস অনুপ্রাস – শব্দের খেলা, যেখানে ধ্বনির মিল একটি বিশেষ আবেদন সৃষ্টি করে।
  • শব্দবন্ধের শৈল্পিকতা – একই বাক্যে অনেক অর্থ ও ইঙ্গিত গাঁথা।
  • প্রতীক রূপক – সমাজ, ধর্ম, নৈতিকতা ও বুদ্ধির প্রতীকী উপস্থাপনা।
  • শ্লেষ ধাঁধার ব্যবহার – পাঠকের বুদ্ধি ও ব্যাকরণিক জ্ঞানকে চ্যালেঞ্জ করে।

হারিরী একটি চরম পরীক্ষার দিকে পাঠককে নিয়ে যান—যেখানে শুধু গল্প নয়, ভাষাও একটি চরিত্র।

 

দুটি মুখ্য চরিত্র

মাকামাতে হারিরীর সব কাহিনির কেন্দ্র দুইটি চরিত্র—

১. আবু জায়েদ আল-সারুজী

একজন ধূর্ত, অভিজ্ঞ, দরিদ্র অথচ জ্ঞানী ভ্রাম্যমাণ মানুষ। বিভিন্ন জায়গায় গিয়ে সে নিজের বাগ্মিতা, কবিত্ব কৌশলের মাধ্যমে অর্থ উপার্জন করে। কখনও ভিক্ষুক, কখনও হাকিম, কখনও শিক্ষক বা কাহিনীকার রূপে আত্মপ্রকাশ করে।

২. আল-হারিস ইবনে হাম্মাম

এই চরিত্রটি হল আলহারিরীর মুখপাত্র। পাঠকের মতো সে-ও আবু জায়েদের কাজকর্ম দেখে বিস্মিত হয়, হাসে, প্রতারিত হয়, কিন্তু শেষে তাকে শ্রদ্ধা করে।

 

কাহিনির রঙবেরঙ

হারিরীর ৫০টি মাকামা বিভিন্ন কাহিনির উপর ভিত্তি করে নির্মিত, যার মধ্যে রয়েছে—

  • ভিক্ষাবৃত্তি ও প্রতারণার কৌশল
  • কাব্য পাঠের প্রতিযোগিতা
  • ভাষার অলঙ্কার নিয়ে বিচারসভা
  • ধর্মীয়, সামাজিক বা নৈতিক শিক্ষামূলক পরিস্থিতি
  • উপদেশ, কৌশল ও আত্মজিজ্ঞাসা

প্রতিটি মাকামা একটি ছোট নাটকের মতো গঠিত, যেখানে চরিত্র, সংলাপ ও চমক তিনটি স্তরে কাজ করে।

 

মাকামা মানে শুধু গল্প নয়

মাকামাতে হারিরী শুধুমাত্র কল্পিত গল্প নয়; বরং এটি—

  • ভাষার চর্চাগার
  • ব্যাকরণের পাঠশালা
  • সমাজের দর্পণ
  • ধর্মীয় শিক্ষা
  • নৈতিক দিকনির্দেশনা
  • মানব চরিত্রের বিশ্লেষণ

তার সাহিত্য এতটাই মননশীল ও গভীর যে একে কোরআন আরবি ব্যাকরণ ছাড়া শ্রেষ্ঠ ভাষাশিল্প বলা হয়ে থাকে।

 

কাকে উদ্দেশ্য করে রচিত?

মাকামাতে হারিরী রচিত হয়েছে মূলত শিক্ষিত পাঠক-দের উদ্দেশ্যে। যারা—

  • আরবি ভাষায় দক্ষ
  • অলংকার, ব্যাকরণ, ছন্দ, শব্দচাতুর্যে পারদর্শী
  • সাহিত্যিক কৌতুক ও বুদ্ধির প্রতি আকৃষ্ট

এই কারণে এটি মধ্যযুগের উচ্চশ্রেণির সাহিত্যিক সম্পদ হিসেবে পরিগণিত হয়।

 

আবু জায়েদ আল-সারুজী – ধূর্ত চরিত্রের বহুমাত্রিকতা

কে এই আবু জায়েদ?

মাকামাতে হারিরীর প্রতিটি কাহিনির কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছেন আবু জায়েদ আলসারুজী। তিনি একজন ভবঘুরে, ধূর্ত, মেধাবী এবং অভিনয়প্রতিভাসম্পন্ন মানুষ, যিনি জীবনযুদ্ধে ভাষাকে তার প্রধান অস্ত্র বানিয়েছেন। আবু জায়েদ কখনও কবি, কখনও পণ্ডিত, কখনও বক্তা, আবার কখনও ধর্মগুরু রূপে আবির্ভূত হয়ে থাকেন।

 

রূপ বদলের কারিগর

আবু জায়েদের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হল তার অসাধারণ ছদ্মবেশ ধারণের ক্ষমতা। তিনি প্রতিটি মাকামায় নিজেকে এমনভাবে উপস্থাপন করেন, যেন তিনি সেই পরিস্থিতির প্রকৃত বাসিন্দা। যেমন:

  • একজন অসুস্থ রোগী হয়ে চিকিৎসার নামে দান নিচ্ছেন
  • বিপদগ্রস্ত কবি সেজে শ্রোতাদের কাঁদিয়ে তুলছেন
  • ধর্মীয় বক্তা রূপে জনতার মন জয় করছেন
  • ব্যবসায়ী সেজে কৌশলে প্রতারণা করছেন
  • আবার কখনো দার্শনিকের মতো জ্ঞানগর্ভ উপদেশ দিচ্ছেন

এই বৈচিত্র্যময় উপস্থাপন তাঁকে একটি চিরপরিচিত কিন্তু ধরা না পড়া প্রতিভা হিসেবে গড়ে তোলে।

 

ভাষার যাদুকর

আবু জায়েদ শব্দের খেলোয়াড়। তার প্রতিটি সংলাপে রয়েছে:

  • চমৎকার ছন্দময়তা (Saj’)
  • ব্যঞ্জনাধ্বনি ও অনুপ্রাসের মিল
  • শ্লেষ ও ধাঁধার সংমিশ্রণ
  • ইসলামী ও কুরআনিক রেফারেন্স
  • হাদীস ও প্রবাদপ্রবচনের অনুকরণ
  • দার্শনিক বোধ ও সমাজ সমালোচনার সংলগ্নতা

তিনি ভাষাকে এমনভাবে ব্যবহার করেন যে, শোনার পর মানুষ চুপ থাকতে পারে না—হয় হাসে, নয় চমৎকৃত হয়।

 

নায়ক না প্রতারক?

এই প্রশ্নটি মাকামাতে হারিরীর পাঠকদের মনে বারবার ফিরে আসে:
আবু জায়েদ কি সমাজের একজন প্রতারক, না ভাষাশিল্পের মহানায়ক?

তিনি—

  • মানুষের সহানুভূতি আদায়ে ছলনা করেন
  • কখনও মিথ্যা বলেন, প্রতারণা করেন
  • কিন্তু কখনও নিচু মানসিকতা দেখান না
  • তাঁর লক্ষ্য কখনোই ধনসম্পদ নয়, বরং শ্রদ্ধা শ্রোতাদের মন জয় করা

তাই অনেক গবেষক বলেন, তিনি ধূর্ত হলেও নৈতিকভাবে দেউলিয়া নন। বরং তিনি একটি বুদ্ধিবৃত্তিক বিপ্লবের প্রতীক

 

দার্শনিক দিক

আবু জায়েদের কাহিনিগুলোতে আমরা দেখি—

  • জীবনের কঠিন বাস্তবতা
  • দরিদ্র মানুষের টিকে থাকার সংগ্রাম
  • শাসকের প্রতি ব্যঙ্গ
  • সমাজের অন্যায় ও ভণ্ডামির বিরুদ্ধাচরণ
  • মানুষের ওপর বিশ্বাস হারিয়ে বুদ্ধি দিয়ে জীবনযাপন

তিনি যেন একজন মধ্যযুগীয় আরবি দিওজেনিস— যিনি সমাজকে আয়নায় দেখে তার কুৎসিত চেহারার প্রতিচ্ছবি তুলে ধরেন।

 

প্রতিটি মাকামায় এক নতুন আবিষ্কার

আবু জায়েদ এমন এক চরিত্র, যাকে আমরা প্রতিটি মাকামায় নতুনরূপে দেখি। পাঠকের দৃষ্টিভঙ্গি প্রতিনিয়ত পরিবর্তিত হয়—

  • কখনও তিনি ভবঘুরে জ্ঞানী
  • কখনও নিপুণ প্রতারক
  • কখনও শ্রেষ্ঠ কবি
  • আবার কখনও দার্শনিক পণ্ডিত

এই পরিবর্তনশীলতা চরিত্রটিকে মানব প্রকৃতির প্রতীক হিসেবে গড়ে তোলে। তিনি শুধু একজন চরিত্র নন, বরং একটি ধারাবাহিক রূপান্তরের রূপক

 

আল-হারিস ইবনে হাম্মাম – বিস্ময়ের পর্যবেক্ষণে বাস্তবতার দর্পণ

কে এই আল-হারিস?

আলহারিস ইবনে হাম্মাম হচ্ছেন মাকামাতে হারিরীর বর্ণনাকারী (narrator)—এই চরিত্রটির মাধ্যমেই পাঠক আবু জায়েদ ও মাকামার অন্যান্য রঙিন কাহিনি জানতে পারেন। একদিকে তিনি গল্প বলছেন, আবার অন্যদিকে বিচারক, বিশ্লেষক, মুগ্ধ শ্রোতা এবং মরাল শিক্ষক—এই চারটি ভূমিকা একসাথে পালন করছেন।

 

একজন বিশ্বাসযোগ্য ভাষ্যকার

আল-হারিস তার সহজ, অথচ কাব্যময় ভাষা, তীক্ষ্ণ পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা এবং উপলব্ধিমূলক প্রতিক্রিয়া দিয়ে কাহিনিকে বাস্তবসম্মত করে তুলেছেন।

  • তিনি প্রত্যক্ষদর্শী
  • বিস্মিত দর্শক
  • যুক্তিবাদী চিন্তক
  • এবং কখনও কখনও আবু জায়েদের প্ররোচনার শিকার

যখন আবু জায়েদ ছলচাতুরী করে কিছু অর্জন করেন, তখন আল-হারিস একদিকে তা অনুধাবন করেন, অপরদিকে কখনও সম্মোহিত হয়ে মুগ্ধ থাকেন।

 

একটি নৈতিক আয়না

আল-হারিস মাকামাগুলোর মধ্যে নৈতিক বোধের প্রতিনিধিত্ব করেন। পাঠক যখন আবু জায়েদের কৌশলে বিভ্রান্ত হয়ে যান, তখন আল-হারিসের প্রতিক্রিয়ায় তারা বোঝেন—এই কাজটি নৈতিকভাবে ঠিক না ভুল।

  • তিনি আবু জায়েদের বিরুদ্ধে কোনো সরাসরি অভিযোগ তোলেন না
  • কিন্তু তার প্রশ্ন, দৃষ্টিভঙ্গি প্রতিক্রিয়া পাঠকের মনে দ্বিধা ও জিজ্ঞাসা জাগিয়ে তোলে

এভাবে তিনি পাঠকের বিবেকের প্রতিনিধিত্বকারী চরিত্র

 

সাহিত্যিক কৌশল হিসেবে বর্ণনাকারী

আরবি সাহিত্যে “বর্ণনাকারী চরিত্র” একটি জনপ্রিয় কৌশল, যেখানে মূল নায়ককে বুঝতে পাঠককে একজন চরিত্রের চোখ দিয়ে দেখতে হয়। হারিরী এই কৌশলকে দক্ষভাবে ব্যবহার করেছেন:

  • মাকামার প্রতিটি গল্প আল-হারিসের মুখ দিয়ে বলা
  • আবু জায়েদের কার্যকলাপ, সংলাপ, পরিবর্তনশীল রূপ সবই তার বর্ণনায় ফুটে ওঠে
  • তার মনোভাব গল্পের টোন নির্ধারণ করে

এইভাবে আল-হারিস কাহিনির কাঠামোতে ভারসাম্য রক্ষা করেন

 

আবু জায়েদ ও আল-হারিস: এক অদ্ভুত দ্বৈত সম্পর্ক

এই দুটি চরিত্র যেন আরবি সাহিত্যের শরলতা চাতুর্যের দ্বন্দ্ব, নৈতিকতা বাস্তবতার সংঘর্ষ, এবং জ্ঞান অভিজ্ঞতার অনন্ত সংলাপ

আবু জায়েদআল-হারিস
চাতুর্য ও ছলনায় পারদর্শীসরল, যুক্তিবাদী
জীবিকার জন্য ভাষা ব্যবহার করেনভাষার মুগ্ধ শ্রোতা
সমাজের মুখোশ উন্মোচন করেনসমাজের নৈতিক দিক তুলে ধরেন
একেক মাকামায় নতুন রূপে আবির্ভূতসর্বদা ধ্রুব ও নিরপেক্ষ

তাদের এই সম্পর্ক পাঠককে সতর্ক পাঠক বিচারক হয়ে উঠতে সাহায্য করে।

 

প্রতীকী ব্যাখ্যা

আল-হারিস অনেক গবেষকের মতে পাঠকের আত্মপ্রতিফলন। তিনি যে প্রশ্ন করেন, পাঠকের মনে সেই প্রশ্নই ওঠে। উদাহরণস্বরূপ:

“এই ব্যক্তি বারবার প্রতারণা করছে, তবুও আমি তাকে শ্রদ্ধা করছি কেন?”

এ প্রশ্ন শুধু আল-হারিস নয়, আমাদের সকলের। তাই তিনি একধরনের সাহিত্যিক বিবেকের প্রতীক

 

নৈতিক শিক্ষা ও সামাজিক ব্যঙ্গ – মাকামার ভিতরের গোপন বার্তা

শুধুই গল্প নয়—মাকামা এক পাঠশালা

মাকামাতে হারিরীর প্রতিটি গল্প কেবল ভাষার কারুকার্য বা নাটকীয় কৌশল প্রদর্শনের জন্য নয়—প্রত্যেক মাকামার ভিতরে রয়েছে একেকটি নৈতিক ও সামাজিক বার্তা। এগুলো কখনও স্পষ্ট, কখনও রূপক। হারিরী শুধুমাত্র মানুষকে মুগ্ধ করতে চাননি, তিনি চেয়েছেন চিন্তা জাগাতে

 

মাকামা ও “আখলাক”—নৈতিকতার মিলন

ইসলামি সাহিত্যধারায় আখলাক বা চরিত্র গঠনের বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। হারিরীর মাকামাগুলোতে আমরা বারবার নৈতিকতার প্রশ্নে ফিরে যাই:

  • প্রতারণা কি সবসময় দোষের?
  • মেধা কৌশল কি ন্যায়ের থেকে বড়?
  • জীবিকা অর্জনের জন্য কি মিথ্যা বৈধ?

এইসব প্রশ্নের জবাব সরাসরি দেওয়া হয় না—বরং পাঠককে ভাবতে বাধ্য করা হয়।

 

সামাজিক ব্যঙ্গের অস্ত্র

আবু জায়েদের ছলনা অনেক সময় সামাজিক কূপমণ্ডূকতা, ধর্মীয় ভণ্ডামি, মূর্খ নেতৃত্ব, অভিজাত শ্রেণির ভোগবিলাস—এসবের বিরুদ্ধে এক তীক্ষ্ণ ব্যঙ্গ। উদাহরণস্বরূপ:

  • ধর্মগুরুর ভান করে সে মানুষের দান গ্রহণ করে—এটা সমাজের ধর্মীয় ভণ্ডামির প্রতি আঙুল তোলে।
  • বিচারকের মুখে মিষ্টি কথা বলে রায় ঘুরিয়ে নেয়—এটা ন্যায়বিচারে দুর্বলতা দেখায়।

হারিরী যেন চিরন্তন প্রশ্ন তোলেন:
“বুদ্ধিমান লোক যদি সমাজের দুর্বলতাকে ব্যবহার করে নিজের জীবন চালিয়ে নেয়, তবে ভুলটা কার?”

 

আদর্শ ও বাস্তবতার দ্বন্দ্ব

মাকামাতে হারিরী মেলে আদর্শ নৈতিকতাবাস্তব জীবনের বাস্তবতার এক দ্বন্দ্ব।

আদর্শবাস্তবতা
সত্যবাদিতাকখনও প্রতারণায় জয়
আত্মসম্মানজীবিকার জন্য বিক্রি হতে বাধ্য
শুদ্ধ জীবনসিস্টেমের ফাঁক-ফোঁকড়ে কৌশলই কার্যকর

এই দ্বন্দ্ব থেকেই জন্ম নেয় সাহিত্যিক নাটকীয়তা নৈতিক দার্শনিকতা

 

পাঠকের চিন্তা জাগানো

হারিরীর উদ্দেশ্য কেবল মজানো নয়—তিনি চান পাঠক নিজেই বিচার করুক। এজন্য তিনি জটিল প্রশ্নগুলো ছবির মতো চিত্রিত করেন, কোনো সরাসরি উপদেশ না দিয়ে পাঠকের বিবেকের দোরে কড়া নাড়েন।

তিনি আমাদের মুখে মুখে হাসি ফোটান, আবার মনে মনে কাঁদতেও বাধ্য করেন।

 

আল-কল্লোল ও ফেরারী ফৌজের পূর্বাভাস?

অনেকে বলেন, হারিরীর মাকামা ধারার নৈতিক ব্যঙ্গ পরবর্তীকালে উৎপল দত্ত, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, প্রমথ চৌধুরীর অনেক সাহিত্যিক কাজের পূর্বাভাস বহন করে।

তাঁর এই কৌশলে মেলে:

  • রঙ্গ
  • বিদ্রুপ
  • শিক্ষণীয় উপসংহার

 

কিছু মাকামার উদাহরণ:

  1. মাকামা আলনাইসাবুরিয়া – এক ভণ্ড ধর্মগুরুর ছদ্মবেশ
  2. মাকামা আলআলজিয়ার – মিথ্যা কবিতা ও বাহবা আদায়
  3. মাকামা আলসিরাফিয়া – ফকির ছদ্মবেশে দান সংগ্রহ

এই সব গল্পেই পাঠকের মনে প্রশ্ন জাগে:

  •  “এই সমাজ কি সত্যিই ন্যায়বিচার দিতে সক্ষম?”
  •  “আমরা আসলে কাকে প্রতারক বলি?”

 

আরবি গদ্যসাহিত্যে হারিরীর প্রভাব

মাকামার ভাষার বাইরে—এক নতুন সাহিত্যের পথিকৃৎ

মাকামাতে হারিরীর সাহিত্যশৈলী শুধু তার সময়ের পাঠকদের মুগ্ধ করেনি, বরং আরবি গদ্যসাহিত্যের ভবিষ্যৎ গতিপথকেও গভীরভাবে প্রভাবিত করেছে। তিনি প্রাচীন ও আধুনিকের মাঝে একটি সাহিত্যিক সেতুবন্ধন তৈরি করেছিলেন। মাকামা, যা একসময় একটি নির্দিষ্ট ধারার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল, হারিরীর হাতে হয়ে উঠেছিল সামাজিক, রাজনৈতিক নৈতিক বক্তব্যের শক্তিশালী মাধ্যম

 

গদ্যের কাঠামোয় কাব্যের উজ্জ্বলতা

হারিরী প্রমাণ করেছিলেন, গদ্যও কাব্যের মতো সুশ্রী সংগীতময় হতে পারে। তার লিখিত গদ্যে ছন্দ, অলংকার, শব্দখেলা ও উপমার সমন্বয়ে যে শব্দরস গড়ে উঠেছে, তা যুগ যুগ ধরে আরবি গদ্যকারদের জন্য একটি আদর্শ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

অনেক সাহিত্যতত্ত্ববিদ মনে করেন, হারিরী গদ্যকে একটি শিল্পমাধ্যমে রূপান্তর করেছিলেন, যা পূর্বে মূলত তথ্যবাহী হিসেবে ব্যবহৃত হতো।

 

সাহিত্যিক অনুসরণ ও অনুকরণ

হারিরীর প্রভাব এতটাই বিস্তৃত ছিল যে, পরবর্তীকালে বহু আরবি সাহিত্যিক—বিশেষ করে:

  • আলকাসিম
  • ইবনে নুবাতা
  • আবু আলআলা আলমাররি
  • আবদ আলকাহার আলজুরজানি

তাঁর শৈলী অনুকরণ করে সাহিত্য রচনা করেন। এমনকি হিন্দ, পারস্য ও তুর্কি সাহিত্যে এই প্রভাবের ছায়া পড়েছিল।

 

শিক্ষা ও অলঙ্কারবিদ্যার পাঠ্যবই

মাকামাতে হারিরীর আরেকটি বড় অবদান হলো, তার গ্রন্থটি আরবি ভাষা শিক্ষার পাঠ্যবই হিসেবে প্রতিষ্ঠা পাওয়া। মাদ্রাসা ও শিক্ষাকেন্দ্রগুলোতে দীর্ঘকাল ধরে “মাকামাতে হারিরী” ছিল ব্যাকরণ ও অলঙ্কারবিদ্যার চর্চার অবিচ্ছেদ্য অংশ।

শিক্ষকরা তাঁর লেখা ব্যবহার করে শিখাতেন—

  • বাক্যগঠন
  • ছন্দ ও অলংকার
  • রূপক, অনুপ্রাস, শ্লেষ
  • শব্দচয়ন ও অর্থবিভব

 

শিল্পকলায় প্রভাব

হারিরীর মাকামাগুলো শুধু সাহিত্যের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না। বিখ্যাত আরবি ক্যালিগ্রাফার ইয়াকুত আলমুস্তাসিমি ও অন্যান্য শিল্পীরা মাকামাতে হারিরী’র পাণ্ডুলিপি অলঙ্করণ করেন অসাধারণ ক্যালিগ্রাফি ও মিনিয়েচার আর্টে।

  • বাগদাদী স্কুল থেকে শুরু করে
  • মামলুক মুঘল চিত্রশিল্প পর্যন্ত

তার গল্পগুলো হয়ে ওঠে চিত্রকলার অনুপ্রেরণা

 

গদ্যের দিকনির্দেশ

হারিরী প্রমাণ করে দিয়েছিলেন যে, সাহিত্যিকতা শুধু ছন্দোবদ্ধ কবিতার মধ্যেই নিহিত নয়। তার গদ্য নান্দনিকতা ও দার্শনিক ভাবনাকে এমনভাবে মেলে ধরেছিল যে, তা গদ্যসাহিত্যের মর্যাদা বাড়িয়ে তোলে। তার আগে অনেকেই গদ্যকে নিচু মর্যাদার মনে করত। হারিরী সেই ধারণাকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে গদ্যকে সাহিত্যচর্চার রাজপথে প্রতিষ্ঠা করেন

 

কূটনীতি, রাজসভা ও জ্ঞানচর্চায় ব্যবহার

হারিরীর লেখা চিঠিপত্রের ভাষাশৈলী পরবর্তীকালে:

  • রাজকীয় প্রজ্ঞাপন
  • কূটনৈতিক ভাষা
  • বক্তৃতা খুতবা
    – এসব ক্ষেত্রেও অনুকরণীয় হয়ে ওঠে।

মধ্যযুগীয় ইসলামি সভ্যতার সাহিত্যে ভাষার মার্জিত ব্যবহার ও অন্তর্নিহিত ব্যঙ্গরস– দুই ক্ষেত্রেই হারিরীর প্রভাব অনস্বীকার্য।

 

মাকামাতে হারিরী – পাণ্ডুলিপি ও চিত্রকলার শিল্পসমৃদ্ধ জগৎ

সাহিত্য থেকে শিল্পে—হারিরীর মাকামার ভিজ্যুয়াল রূপ

হারিরীর সাহিত্য শুধু কণ্ঠে পাঠ বা পাঠ্যপুস্তকেই সীমাবদ্ধ ছিল না; এটি হয়ে উঠেছিল চিত্রকলার এক ঐন্দ্রজালিক অনুপ্রেরণা। মধ্যযুগীয় ইসলামী সভ্যতার সবচেয়ে শিল্পসমৃদ্ধ পাণ্ডুলিপিগুলোর মধ্যে মাকামাতে হারিরী’অলঙ্কৃত সংস্করণ অন্যতম। এ পর্বে আমরা জানব কীভাবে হারিরীর সাহিত্যিক গদ্য চিত্রকলার মাধ্যমে জেগে উঠেছে রঙ, রেখা, আকার ও ব্যাখ্যার সম্মিলনে।

 

বিখ্যাত পাণ্ডুলিপি: বাগদাদ সংস্করণ

সবচেয়ে খ্যাতনামা পাণ্ডুলিপি হলো:

  • ১৩ শতকে তৈরি বাগদাদী মাকামা পাণ্ডুলিপি, যা বর্তমানে বিবলিওথেক ন্যাশনাল, প্যারিস-এ সংরক্ষিত আছে।

এই পাণ্ডুলিপিতে রয়েছে:

  • ৫০টি মাকামার প্রতিটি অংশের জন্য চিত্রায়ন
  • মোট ৯৯টি বিস্ময়কর মিনিয়েচার চিত্র
  • উৎকৃষ্ট নাসখ ক্যালিগ্রাফিতে লেখা সুন্দর হস্তলিখিত পাণ্ডুলিপি

প্রতিটি ছবি শুধু আলংকারিক নয়, বরং কাহিনির প্রকৃত রস, চরিত্রের মুখভঙ্গি, সামাজিক প্রেক্ষাপট – সব তুলে ধরে।

 

শিল্পী ইয়াহিয়া ইবন আল-ওয়াসিতি – এক যুগান্তকারী নাম

এই অনবদ্য শিল্পকর্মের পেছনে যিনি ছিলেন, তিনি হলেন:

ইয়াহিয়া ইবন আল-ওয়াসিতি
– একজন বিখ্যাত চিত্রশিল্পী ও ক্যালিগ্রাফার। তিনি নিজেই এই পাণ্ডুলিপি তৈরি করেন এবং তার ভেতরে প্রতিটি গল্পকে চিত্রের মাধ্যমে জীবন্ত করে তোলেন

তিনি আরবি সাহিত্যে প্রথম ব্যক্তি, যিনি সাহিত্যের সঙ্গে ইলাস্ট্রেশনকে সম্পূর্ণরূপে একীভূত করেন

 

চিত্রগুলোর বৈশিষ্ট্য

ইবন আল-ওয়াসিতির আঁকা চিত্রগুলোতে রয়েছে:

  • আরবদের দৈনন্দিন জীবনযাত্রার চিত্র (হাট-বাজার, কফি হাউস, ভিক্ষুক, ধনীরা, ছাত্র-শিক্ষক, জজ, সওদাগর ইত্যাদি)
  • বর্ণময় পোশাক, মাথায় পাগড়ি, খেজুরগাছ, স্থাপত্য, গালিচা, আসবাব
  • আবেগপ্রবণ মুখাবয়ব, হাস্যরসাত্মক ভঙ্গি, নাটকীয় গতি
  • চরিত্রদের অভিব্যক্তিতে ফুটে ওঠা কৌতুক, ব্যঙ্গ, চিন্তা দ্বন্দ্ব

এই চিত্রগুলোর মধ্যে একটি বড় অর্জন হলো:
চিত্রগুলো শুধুই অলংকরণ নয়, বরং সাহিত্যের বিস্তৃত অনুবাদ।

 

ইসলামি শিল্পে ব্যতিক্রম

যদিও ইসলামি চিত্রকলায় মানবমূর্তি অঙ্কন অনেক সময় নিরুৎসাহিত ছিল, তথাপি:

  • হারিরীর মাকামা ছিল একটি ব্যতিক্রমী সাহিত্যিক শিল্পবস্তু, যেখানে মানব চরিত্র চিত্রায়নে ধর্মীয় বিধি কিছুটা শিথিল হয়ে উঠে।

এই পাণ্ডুলিপির মাধ্যমে প্রমাণ হয় যে:
ইসলামী সভ্যতায় শিল্প কখনও নিছক নিষিদ্ধ ছিল না, বরং বিশ্লেষণ প্রসঙ্গে তার স্থান ছিল।

 

পরবর্তী প্রভাব

এই মাকামার চিত্রাঙ্কিত সংস্করণ:

  • মামলুক, পারস্য মুঘল শিল্পীদের অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে
  • পারস্যে শাহনামা ও ভারতে আকবরনামা-র মতো চিত্রনাট্য রচনায়ও এই ধারা অব্যাহত থাকে
  • ইউরোপীয় সাহিত্যিকরা মাকামা এবং এর পাণ্ডুলিপি দেখে অভিভূত হন
  • পরবর্তীতে পণ্ডিতেরা মাকামাতে হারিরীকে কেবল সাহিত্যের নয়, বরং মধ্যযুগীয় আরব শিল্পের শ্রেষ্ঠ উদাহরণ হিসেবে গণ্য করেন

 

মাকামাতে হারিরী – ভাষা, রীতি ও অলঙ্কারশৈলীর বিস্ময়

সাহিত্য নয়, যেন এক অলংকারে বাঁধানো শব্দের শিল্পকর্ম

‘মাকামা’ শব্দের আভিধানিক অর্থ—”আসন”, বা “বক্তৃতা দেওয়ার স্থান”। কিন্তু হারিরীর মাকামা শুধু বক্তৃতা বা গল্প নয়, বরং তা এক অপূর্ব ভাষাশৈলীর প্রদর্শনী
এই পর্বে আমরা বিশ্লেষণ করবো মাকামার গদ্যের ভেতরে কীভাবে অলঙ্কার, শব্দচাতুর্য ও ব্যাকরণিক খেলা পাঠককে মোহিত করে।

 

মাকামার ভাষা: কাব্যিক গদ্য বা সজঙ্ঘ prose-poetry

হারিরীর ভাষা হলো:

  • শব্দের জাদুতে মোড়া, আবৃত্তিযোগ্য এবং ছন্দোময়
  • একদিকে গদ্যরূপী কাব্য আবার অন্যদিকে কাব্যের মত গদ্য
  • বিভিন্ন কাব্যরীতি যেমন সজ্জা, অনুপ্রাস, পরিহাস, ব্যঙ্গ, চিত্রকল্প—ব্যবহৃত হয়েছে দক্ষতায়

এই গদ্যের বৈশিষ্ট্য হলো, আপনি পড়লে একরকম অনুভব করবেন, আবৃত্তি করলে আরেক রকম সুরেলা আনন্দ পাবেন।

 

অলঙ্কারশৈলী: শব্দ ও অর্থের খেলাঘর

১. সাজা‘ (Saj‘) বা ছন্দময় গদ্য:

আরবি সাহিত্যের জনপ্রিয় অলঙ্কার—একই শব্দতাল বা ছন্দে গঠিত বাক্য
উদাহরণ:

“আখাযা মিন আল-মাল, ওয়ামতালা মিন আল-হাল”

২. তাজনিস (Paronomasia):

একই শব্দের পুনরাবৃত্তি করে আলাদা অর্থ তৈরি করা

যেমন: ‘’আমর’’ ও ‘’উমর’’

৩. তিবাক ও মুকাবালা:

বিপরীতার্থক শব্দের জোড়া ব্যবহার

যেমন: জীবন-মরণ, দিন-রাত

৪. ইহাম:

শব্দের দ্ব্যর্থবোধকতা—একটি শব্দ একাধিক অর্থে ব্যবহৃত

এসব অলঙ্কার ব্যবহার হারিরীকে শুধুই সাহিত্যিক নয়, বরং একজন অলঙ্কার রচয়িতা শিল্পী করে তুলেছে।

 

বাক্যগঠন ও ছন্দ

মাকামাতে ব্যবহৃত বাক্যগুলো:

  • অত্যন্ত জটিল গঠনের
  • বাগধারা ও উপমায় ভরপুর
  • অনেক সময় গল্প বলার চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয় ভাষার নকশা

পাঠক গল্প ভুলে যেতে পারে, কিন্তু বাক্যরূপী অলংকারের সুর তার মনে গেঁথে যায়।

 

নাট্যরীতির প্রভাব

মাকামাতে রয়েছে:

  • সংলাপভিত্তিক কাহিনি
  • একটি প্রধান বর্ণনাকারী (হারিরী নিজে)
  • এবং এক প্রবঞ্চক চরিত্র – আবু জায়েদ
    → এরা কথোপকথনে এমনভাবে ভাষা ব্যবহার করেন যে, পাঠক মুগ্ধ হয়ে শুধু মুগ্ধতা নিয়েই থামে না, বরং ব্যঙ্গ ও রসবোধও অনুভব করে।

 

ভাষার ভৌগোলিক বিস্তার

হারিরীর আরবি ভাষা ছিল:

  • শাস্ত্রীয় ক্লাসিক আরবি (Fus’ha)
  • তবে সেখানে রয়েছে অঞ্চলভেদে প্রচলিত কিছু শব্দও
  • একই সঙ্গে ব্যবহার হয়েছে:
    • কোরআনিক বাগধারা
    • জাহেলি যুগের কাব্যিক ধারা
    • এবং সমসাময়িক লোকরীতি

এর ফলে মাকামা হয়ে ওঠে—এক যুগের চিত্র, ভাষার দর্পণ।

 

শিক্ষার্থীদের জন্য পাঠ্য

হারিরীর এই ভাষার কৌশল এতটাই সমৃদ্ধ যে:

  • মধ্যযুগ থেকে আজ পর্যন্ত আরবি ভাষা শিক্ষার জন্য অন্যতম ক্লাসিক হিসেবে এটি ব্যবহার হয়
  • কায়রো, দামেস্ক, বাগদাদ, তিউনিস এবং আলজিয়ার্সের মাদ্রাসাগুলোতে এটি ছিল পাঠ্য

শিক্ষার্থীরা এর মাধ্যমে শেখে:

  • উচ্চারণরীতি
  • ব্যাকরণ
  • অলঙ্কার
  • এবং সর্বোপরি, বক্তৃতা কৌশল

 

মাকামাতে হারিরী – উত্তরাধিকার ও আধুনিক প্রাসঙ্গিকতা

শেষ নয়, শুরু একটি চিরন্তন ঐতিহ্যের

“মাকামাতে হারিরী” কেবল মধ্যযুগের একটি সাহিত্যকর্ম নয়—এটি এক ঐতিহাসিক, নান্দনিক ও ভাষাগত উত্তরাধিকার।
এই পর্বে আমরা জানবো:

  • মাকামার প্রভাব আরবি সাহিত্য, সংস্কৃতি, ও শিক্ষায় কীভাবে গেঁথে আছে
  • এবং আধুনিক যুগে এই সাহিত্যকর্ম কীভাবে পুনরুজ্জীবিত হচ্ছে

 

হারিরী: এক উত্তরাধিকার-স্রষ্টা

হামাদানির পথ ধরে হারিরী:

  • মাকামা ধারাকে দান করেছেন একটি পূর্ণাঙ্গ গঠন
  • সংলাপ, কল্পনা, রসবোধ, অলংকার ও ছন্দের মাধ্যমে এটিকে জনপ্রিয় করে তুলেছেন
  • শুধু লেখক হিসেবে নয়, তিনি হয়ে উঠেছেন এক শৈলীর গুরু

হারিরীর মৃত্যুর পরও তার রচনাবলি শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে পাঠ্য ও শ্রুতিমধুর সাহিত্য হিসেবে টিকে আছে।

 

শিক্ষা ও পাঠ্যক্রমে মাকামা

হারিরীর মাকামা বহু শতাব্দী ধরে:

  • মিশর, সিরিয়া, ইরাক, আন্দালুস ও ভারতের মুসলিম শিক্ষা ব্যবস্থার পাঠ্য ছিল
  • আরবি ভাষা শিক্ষা, ব্যাকরণ, অলঙ্কার ও বক্তৃতা কৌশলে এটি ছিল আদর্শ
  • বক্তৃতাশিল্পীদের, কবিদের ও প্রশাসনিক লেখকদের জন্য এটি ছিল দৃষ্টান্ত

আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয়, জাইতুনা মাদ্রাসা, নিজামিয়া—সব জায়গায় মাকামার পাঠ ছিল বাধ্যতামূলক।

 

চিত্রকলায় মাকামা: এক চিত্রিত ঐতিহ্য

১৩শ শতকে আল-ওয়াসিতি নামক এক বিখ্যাত শিল্পী হারিরীর মাকামা থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে প্রতিটি গল্প চিত্রিত করেন।
এই ইলাস্ট্রেটেড মাকামা এখন প্যারিসের Bibliothèque nationale de France-এ রক্ষিত।

এই চিত্রকর্মগুলোর মাধ্যমে:

  • আমরা জানতে পারি সেই সময়কার পোশাক, খাদ্যাভ্যাস, জীবনের রীতি
  • এবং একই সঙ্গে ভাষা ও সাহিত্যের চিত্রময় ব্যাখ্যা

 

স্বাধীনতা ও চিন্তার মুক্তি

মাকামাতে রয়েছে:

  • রসিকতা
  • প্রতারণার চালাকি
  • দারিদ্র্যজীবনের চিত্র
  • প্রথাবিরোধী বক্তব্য

এই সবকিছু একত্রে মিলিত হয়ে তৈরি করে একটি স্বাধীনচেতা, প্রথাভাঙা সাহিত্য—যা আধুনিক সাহিত্যেও প্রাসঙ্গিক।

 

আধুনিক পাঠে প্রাসঙ্গিকতা

বর্তমান দিনে হারিরীর মাকামা:

  • অনূদিত হয়েছে ফরাসি, ইংরেজি, জার্মান, তুর্কি ও ফারসি ভাষায়
  • বিশ্ব সাহিত্যের পাঠ্যতালিকায় স্থান করে নিয়েছে
  • আরবি ভাষা শেখাতে এখনো অনেক মাদ্রাসা ও বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠ্য

একই সঙ্গে সাহিত্য বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে একে সারক্যাজম, প্যারোডি পলিটিক্যাল ক্রিটিকের মডেল হিসেবেও দেখা হয়।

 

অনলাইন ও গবেষণার জগতে মাকামা

আজকের দিনে:

  • ডিজিটাল আর্কাইভে সংরক্ষিত হচ্ছে হারিরীর মূল পান্ডুলিপি
  • Google Books, Internet Archive, World Digital Library-তে হারিরীর কাজ সহজলভ্য
  • বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের মিডল ইস্টার্ন স্টাডিজ বিভাগে এ নিয়ে গবেষণা চলছে

কেমব্রিজ, অক্সফোর্ড, আল-আজহার, আলিগড় – সর্বত্র মাকামা নিয়ে একাডেমিক আলোচনা চলছে।

 

উপসংহার: কেন এখনো প্রাসঙ্গিক?

মাকামাতে হারিরী হলো:

  • ভাষার সৌন্দর্যের এক অভিজাত নিদর্শন
  • চিন্তার স্বাধীনতা ও কল্পনার জগতের বিস্তৃতি
  • সাহিত্যিক ব্যঙ্গ, সমাজ-পর্যবেক্ষণ ও রসবোধের এক অনুপম সংমিশ্রণ

তাই এই গ্রন্থ কেবল একটি ঐতিহাসিক দলিল নয়—বরং একটি জীবন্ত সাহিত্যিক উত্তরাধিকার

 

সমাপ্তি

“মাকামাতে হারিরী” পড়া মানে:

  • আরবি ভাষার ঐশ্বর্য উপলব্ধি করা
  • অলঙ্কার, ছন্দ, ভাষাশিল্প ও কল্পনার দুনিয়ায় প্রবেশ করা
  • এবং সাহিত্যের এক অমূল্য সম্পদে হাত রাখা

Leave a Comment