সূরা আল মুমিনূন আজকের ভিডিও এর বিষয়। “সূরা আল-মু’মিনূন (মুমিনগণ) [ Surah Al-Mu’minun (The Believers) ]” আল-কুরআনের [ Al-Quran ] ২৩তম সূরা বা অধ্যায় [ Surah/Chapter 23], এর আয়াত অর্থাৎ বাক্য সংখ্যা ১১৮ টি। এই সূরার মূল বক্তব্য হচ্ছে চারিত্রিক গুণাবলী যা মুমিন বা বিশ্বাসী হওয়ার ‘বীজতলা ‘ বা মূলভিত্তি। বিশেষভাবে উল্লেখ করা হয়েছে সেই রূপ পরিবেশের যখন সত্যকে অস্বীকার করা হয় এবং সত্যের অনুসারীদের অত্যাচার ও অপমানে জর্জরিত করা হয়।
সূরা আল মুমিনূন
উপদেশ প্রদানের ক্ষেত্রে কুরআনের রয়েছে বহু শৈলী। কখনো আদেশ–নিষেধের সুরে, কখনো পূর্ববর্তী উম্মতের ঘটনা বর্ণনার মাধ্যমে, কখনো জান্নাতের সুখ–শান্তি ও জাহান্নামের শাস্তির বর্ণনা দিয়ে, কখনো সৃষ্টিজগতের বিভিন্ন নিআমতের কথা উল্লেখ করে। এছাড়াও আরও বিভিন্ন শৈলীতে কুরআনে কারীমে উপদেশ পেশ করা হয়েছে। প্রতিটি শৈলীরই রয়েছে স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য ও আবেদন।
এই শৈলীগুলোর একটি হল, মুমিনদের বিভিন্ন গুণ ও বৈশিষ্ট্যের বর্ণনা। উদ্দেশ্য হল, মুমিনগণ যেন এসব গুণ–বৈশিষ্ট্যের অধিকারী হয়; ব্যক্তি, পরিবার ও সমাজ জীবনে এগুলোকে গ্রহণ করে।

সূরা মুমিনূনের শুরুতে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন মুমিনের এমনই কিছু বিশেষ গুণ ও বৈশিষ্ট্যের কথা তুলে ধরেছেন। ইরশাদ হয়েছে–
قَدْ اَفْلَحَ الْمُؤْمِنُوْنَ الَّذِیْنَ هُمْ فِیْ صَلَاتِهِمْ خٰشِعُوْن وَ الَّذِیْنَ هُمْ عَنِ اللَّغْوِ مُعْرِضُوْن وَ الَّذِیْنَ هُمْ لِلزَّكٰوةِ فٰعِلُوْن وَ الَّذِیْنَ هُمْ لِفُرُوْجِهِمْ حٰفِظُوْن اِلَّا عَلٰۤی اَزْوَاجِهِمْ اَوْ مَا مَلَكَتْ اَیْمَانُهُمْ فَاِنَّهُمْ غَیْرُ مَلُوْمِیْن فَمَنِ ابْتَغٰی وَرَآءَ ذٰلِكَ فَاُولٰٓىِٕكَ هُمُ الْعٰدُوْن وَ الَّذِیْنَ هُمْ لِاَمٰنٰتِهِمْ وَ عَهْدِهِمْ رٰعُوْن وَ الَّذِیْنَ هُمْ عَلٰی صَلَوٰتِهِمْ یُحَافِظُوْن اُولٰٓىِٕكَ هُمُ الْوٰرِثُوْنَ الَّذِیْنَ یَرِثُوْنَ الْفِرْدَوْسَ هُمْ فِیْهَا خٰلِدُوْنَ.
নিশ্চয়ই সফলতা অর্জন করেছে মুমিনরা; যারা তাদের নামাযে আন্তরিকভাবে বিনীত। যারা অহেতুক বিষয় থেকে বিরত থাকে। যারা যাকাত সম্পাদনকারী। যারা নিজ লজ্জাস্থান সংরক্ষণ করে; নিজেদের স্ত্রী ও মালিকানাধীন দাসীদের ছাড়া অন্য সকলের থেকে, কেননা এতে তারা নিন্দনীয় হবে না। তবে কেউ এছাড়া অন্য কিছু কামনা করলে তারাই হবে সীমালঙ্ঘনকারী। এবং যারা তাদের আমানত ও প্রতিশ্রুতি রক্ষা করে। এবং যারা নিজেদের নামাযের পরিপূর্ণ রক্ষণাবেক্ষণ করে। এরাই হল সেই ওয়ারিশ, যারা জান্নাতুল ফিরদাউসের মীরাস লাভ করবে। তারা তাতে সর্বদা থাকবে। –সূরা মুমিনূন (২৩) : ১–১১
সুনানে কুবরা নাসায়ীর একটি হাদীসে এসেছে, ইয়াযিদ বিন বাবনুস রাহ. বলেন, একদা আমরা হযরত আয়েশা রা.–এর কাছে জিজ্ঞেস করলাম, হে উম্মুল মুমিনীন! কেমন ছিল রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম–এর আখলাক?
তিনি বললেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আখলাক হল কুরআন। এরপর তিনি قَدْ اَفْلَحَ الْمُؤْمِنُوْنَ থেকে وَ الَّذِیْنَ هُمْ عَلٰی صَلَوٰتِهِمْ یُحَافِظُوْنَ পর্যন্ত তিলাওয়াত করেন এবং বলেন, এমনই ছিল রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আখলাক। –সুনানে কুবরা, নাসায়ী ১১২৮৭
উল্লেখিত আয়াতগুলোতে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন মুমিনের সাতটি বৈশিষ্ট্যের কথা উল্লেখ করেছেন :
এক : الَّذِیْنَ هُمْ فِیْ صَلَاتِهِمْ خٰشِعُوْن
যারা তাদের নামাযে আন্তরিকভাবে বিনীত।
প্রথম বৈশিষ্ট্য হল, মুমিন নামাযে ‘খুশু’ অবলম্বন করে। নামায ঈমানের পরে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। মুমিনের চক্ষু–শীতলতা। আল্লাহর নৈকট্য লাভের অনেক বড় একটি মাধ্যম। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন–
وَجُعِلَتْ قُرّةُ عَيْنِي فِي الصّلَاةِ.
নামাযে রাখা হয়েছে আমার চোখের শীতলতা। –সুনানে নাসায়ী, হাদীস ৩৯৪০
অন্য হাদীসে এসেছে–
أَقْرَبُ مَا يَكُونُ الْعَبْدُ مِنْ رَبِّهِ، وَهُوَ سَاجِدٌ.
সিজদারত অবস্থায় বান্দা তার রবের সবচেয়ে বেশি নিকটবতীর্ হয়। –সহীহ মুসলিম, হাদীস ৪৮২
তবে নামাযের মিষ্টতা এবং এর মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য অর্জনের অনুভূতি তখনই উপলব্ধি হবে, যখন নামায ‘খুশু’ এর সাথে আদায় করা হবে। আয়াতে শুধু নামায পড়ার কথা বলা হয়নি; বরং ‘খুশু’-এর সাথে নামায আদায়ের কথা বলা হয়েছে। ‘খুশু’-এর অর্থ হল, বিনয়ের সাথে অন্তরকে আল্লাহর অভিমুখী করা। –তাফসীরে কাবীর ২৩ : ২৫৯
নামাযে ইচ্ছাকৃত অন্তরে অন্য কোনো খেয়াল না আনা। অন্য কোনো খেয়াল এসে গেলে সাথে সাথে মন নামাযের অভিমুখী করা। ‘খুশু’ হাছিলের একটা সহজ পদ্ধতি হল নামাযে যা পড়া হয় তার দিকে ধ্যান রাখা। অর্থ জানা থাকলে অর্থের দিকে খেয়াল করা। দিলের মধ্যে এই অনুভূতি রাখা যে, আমি সর্বক্ষমতাময় আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের সামনে দাঁড়িয়ে আছি। তিনি আমাকে দেখছেন।
‘খুশু’ এর অপরিহার্য দাবি হল, নিজের বাহ্যিক অঙ্গ–প্রত্যঙ্গও স্থির রাখা। (প্রাগুক্ত)
যেটাকে আমরা ‘খুযু’ বলে থাকি। এর সারকথা হল, নামাযের মধ্যে প্রতিটি অঙ্গ সুন্নাহসম্মত পন্থায় রাখা। এজন্য প্রত্যেকের জন্য জরুরি হল, নামাযে কোন্ অবস্থায় কোন্ অঙ্গ কীভাবে রাখতে হয় তার সুন্নাহসম্মত পদ্ধতি জানা এবং সে অনুযায়ী আমল করা।
দুই : وَ الَّذِیْنَ هُمْ عَنِ اللَّغْوِ مُعْرِضُوْنَ
যারা অহেতুক বিষয় থেকে বিরত থাকে।
মুমিনের বিশেষ একটি গুণ হল সে لغو থেকে বেঁচে থাকে। হাদীছ শরীফে এসেছে–
مِنْ حُسْنِ إِسْلَامِ المَرْءِ تَرْكهُ مَا لَا يَعْنِيهِ.
সুন্দর মুসলিম হওয়ার একটি নিদর্শন হল, অর্থহীন কাজ ত্যাগ করা। –জামে তিরমিযী, হাদীস ২৩১৮
অহেতুক বিষয় (لغو) থেকে বেঁচে থাকার সর্বপ্রথম ক্ষেত্র হল, সকল প্রকার গুনাহের কাজ থেকে বিরত থাকা। তেমনিভাবে এমন কথা, কাজ, লেখা ও চিন্তা থেকে বেঁচে থাকা, যাতে না দ্বীনী কোনো ফায়েদা আছে, না দুনিয়াবী কোনো ফায়েদা আছে।
অহেতুক বিষয় (لغو) থেকে বেঁচে থাকার একটি প্রায়োগিক দিক হল, কোনো বেহুদা ও অহেতুক আচরণ বা কথার সম্মুখীন হলে প্রতিউত্তর না দেওয়া, এড়িয়ে চলা। এ প্রসঙ্গে কুরআনে কারীমে ইরশাদ হয়েছে,
وَ اِذَا مَرُّوْا بِاللَّغْوِ مَرُّوْا كِرَامًا.
তারা (রহমানের বান্দারা) যখন বেহুদা কার্যকলাপের পাশ দিয়ে যায় তখন আত্মসম্মান বাঁচিয়ে যায়। –সূরা ফুরকান (২৫) : ৭২
তিন : الَّذِیْنَ هُمْ لِلزَّكٰوةِ فٰعِلُوْن
যারা যাকাত সম্পাদনকারী।
তৃতীয় বৈশিষ্ট্য হল, মুমিন যাকাত আদায় করে। যাকাত ইসলামের একটি গুরুত্বপূর্ণ ফরয বিধান। হাদীসের ভাষায় ইসলামের পঞ্চস্তম্ভের একটি। তাই ঈমানের অপরিহার্য দাবি, যাকাত ফরয হলে যাকাত আদায় করা। যাকাত আদায় না করার ব্যাপারে কুরআন ও হাদীসে কঠিন হুঁশিয়ারি এসেছে। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন ইরশাদ করেন–
وَالَّذِينَ يَكْنِزُونَ الذَّهَبَ وَالْفِضَّةَ وَلَا يُنْفِقُونَهَا فِي سَبِيلِ اللهِ فَبَشِّرْهُمْ بِعَذَابٍ أَلِيمٍ يَوْمَ يُحْمَى عَلَيْهَا فِي نَارِ جَهَنَّمَ فَتُكْوَى بِهَا جِبَاهُهُمْ وَجُنُوبُهُمْ وَظُهُورُهُمْ هَذَا مَا كَنَزْتُمْ لِأَنْفُسِكُمْ فَذُوقُوا مَا كُنْتُمْ تَكْنِزُونَ.
যারা সোনা–রুপা পুঞ্জীভূত করে এবং তা আল্লাহর পথে ব্যয় করে না, তাদেরকে যন্ত্রণাময় শাস্তির ‘সুসংবাদ’ দাও। যেদিন সে ধন–সম্পদ জাহান্নামের আগুনে উত্তপ্ত করা হবে, তারপর তা দ্বারা তাদের কপাল, পাঁজর ও পিঠে দাগ দেয়া হবে (এবং বলা হবে) এই হচ্ছে সেই সম্পদ, যা তোমরা নিজেদের জন্য পুঞ্জীভূত করতে। সুতরাং তোমরা যে সম্পদ পুঞ্জীভূত করতে, তা মজা করে ভোগ কর। –সূরা তাওবা (৯) : ৩৪–৩৫
বুখারী শরীফের এক হাদীসে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন–
مَنْ آتَاهُ اللهُ مَالًا، فَلَمْ يُؤَدِّ زَكَاتَهُ مُثِّلَ لَهُ مَالُهُ يَوْمَ القِيَامَةِ شُجَاعًا أَقْرَعَ لَهُ زَبِيبَتَانِ يُطَوّقُهُ يَوْمَ القِيَامَةِ، ثُمّ يَأْخُذُ بِلِهْزِمَتَيْهِ – يَعْنِي بِشِدْقَيْهِ – ثُمّ يَقُولُ أَنَا مَالُكَ أَنَا كَنْزُكَ، ثُمّ تَلاَ: لَا يَحْسبَنّ الّذِينَ يَبْخَلُون الآيَةَ
যাকে আল্লাহ সম্পদ দান করেছেন, কিন্তু সে যাকাত আদায় করেনি, কিয়ামতের দিন সেই সম্পদকে বিষাক্ত সাপের আকৃতি দিয়ে তার গলায় পেঁচিয়ে দেয়া হবে। সাপটি তার মুখের দু’পার্শ্ব কামড়ে ধরে বলবে, আমি তোমার সম্পদ, আমি তোমার সঞ্চিত মাল। তারপর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এই আয়াত তিলাওয়াত করেন–
وَ لَا یَحْسَبَنَّ الَّذِیْنَ یَبْخَلُوْنَ بِمَاۤ اٰتٰىهُمُ اللهُ مِنْ فَضْلِهٖ هُوَ خَیْرًا لَّهُمْ بَلْ هُوَ شَرٌّ لَّهُمْ سَیُطَوَّقُوْنَ مَا بَخِلُوْا بِهٖ یَوْمَ الْقِیٰمَةِ وَ لِلهِ مِیْرَاثُ السَّمٰوٰتِ وَ الْاَرْضِ وَ اللهُ بِمَا تَعْمَلُوْنَ خَبِیْرٌ.
[আল্লাহ প্রদত্ত সম্পদে যারা কৃপণতা করে, তারা যেন কিছুতেই মনে না করে– এটা তাদের জন্য ভালো কিছু; বরং এটা তাদের পক্ষে অতি মন্দ। যে সম্পদে তারা কৃপণতা করে, কিয়ামতের দিন তা তাদের গলায় বেড়ি বানিয়ে দেওয়া হবে। আকাশ ও পৃথিবীর মিরাছ কেবল আল্লাহরই জন্য। তোমরা যা–কিছুই কর আল্লাহ সে সম্পর্কে সম্যক অবগত। –সূরা আলে ইমরান (৩) ১৮০] –সহীহ বুখারী, হাদীস ১৪০৩
সূরা আল মুমিনূন সূরা পাঠ ঃ
আরও দেখুনঃ